খবর:
আগামী ৩০ বছর পর দেশের মহেশখালী ও মাতারবাড়ী এলাকা সিঙ্গাপুর বা চীনের সাংহাইয়ের মতো হতে পারে। সমুদ্রকেন্দ্রিক শিল্পায়ন, গভীর সমুদ্রবন্দর, জ্বালানী কেন্দ্র, মৎস্য আহরণ কেন্দ্র ও আধুনিক টাউনশিপ গড়ে তোলার মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। আজ বুধবার রাজধানীর বেইলি রোডে অবস্থিত ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিনিয়োগবিষয়ক বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মহেশখালী ও মাতারবাড়ী অঞ্চল ঘিরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে সম্প্রতি মহেশখালী ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা মিডা নামে বিশেষ কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে সরকার। নবগঠিত এ কর্তৃপক্ষের (মিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান করা হয়েছে আশিক চৌধুরীকে। (www.prothomalo.com/business/economics/xl13jod5w5 )
মন্তব্য:
পুরো বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুর বানানোর গল্প গত ১৭ বছরে অনেক শোনানো হয়েছে। এই "সিঙ্গাপুর", "সাংহাই" বা "মালয়েশিয়া" গল্পের পেছনে আসল সত্যটা লুকানো হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, একই সময়ে মহেশখালী নিয়ে ভীষণ তৎপর আছেন বাংলাদেশ সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তরল প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি ‘এক্সিলারেট এনার্জি’র স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজর পিটার হাস। তিনি গত সপ্তাহে স্বদলবলে মহেশখালী সফর করেছেন। পিটার হাস পরে ঢাকায় ফিরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম সিয়ামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এ সময় তাদের মধ্যে বাংলাদেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটির সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে কক্সবাজারের মহেশখালীতে পিটার হাসের প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জির একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। মহেশখালীর ভাসমান টার্মিনালটি বাংলাদেশের প্রথম এলএনজি আমদানির স্থাপনা। এক্সিলারেট এনার্জির মালিকানাধীন মহেশখালী ফ্লোটিং এলএনজি টার্মিনালটি গ্যাস সংরক্ষণ এবং পুনরুৎপাদন ইউনিট হিসেবে কাজ করছে।
পিটার হাসের মহেশখালী কেন্দ্রিক এসব তৎপরতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (IPS)-এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলা করা এবং এ অঞ্চলে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান ঠেকানো। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত, যা বিশ্ব বাণিজ্যের এক-চতুর্থাংশ পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও মহেশখালী দ্বীপ বঙ্গোপসাগরে কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে, যা সমুদ্রপথে নজরদারি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অন্যদিকে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে অবকাঠামোগত বিনিয়োগ বাড়ছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের বিষয়। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বা মহেশখালীতে মার্কিন উপস্থিতি চীনের প্রভাব কমাতে সহায়ক হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে “মেরিটাইম ডোমেইন ফিউশন সেন্টার” প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছে। এই সেন্টারটিতে আঞ্চলিক দেশগুলো করবে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে এর সাথে তথ্য আদান-প্রদান, নৌ-নজরদারি, এবং সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য কাজ করছে। এটি মূলত ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য জাহাজের নিরাপত্তা ও সামরিক কর্তৃত্ব নিশ্চিত উদ্যোগে অংশীদার করার প্রস্তাব দিয়েছে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (IPEF)-এর মাধ্যমে সম্পর্ক জোরদার করতে চায়। মহেশখালীতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সেলারেট এনার্জির এলএনজি টার্মিনালে বিনিয়োগ এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত প্রকল্পে অংশগ্রহণ এই সহযোগিতার অংশ। এই ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের (যেমন: বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) বিপরীতে প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করে। মহেশখালী ঘিরে বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী শিল্পায়ন, গভীর সমুদ্রবন্দর, জ্বালানিকেন্দ্র, মৎস্য আহরণ কেন্দ্র ও আধুনিক টাউনশিপ গড়ে তোলার যেসব পরিকল্পনার কথা বলছেন, এগুলো সবই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (IPEF)-এর সহায়ক প্রকল্প। এজন্যই মহেশখালীকে নিয়ে পিটার হাস ও অন্যান্য মার্কিন কর্মকর্তাদের এতো দৌড়ঝাঁপ।
মহেশখালী কিংবা বাংলাদেশের যেকোন শহরের কিংবা পুরো বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিল্পায়ন অবশ্যই জরুরী। তবে সেই শিল্পায়ন, উন্নয়ন বা অবকাঠামোগত পরিকল্পনা হতে হবে পুরোপুরি বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি তথা বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডাকে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশের কোনো অঞ্চল বা অবকাঠামোকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে বাংলাদেশের জনগণের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা।
- রাশীদ হাসান মেহেদী