ফুরিয়ে যাচ্ছে গ্যাসের মজুত



খবরঃ

দেশে গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন কমছে ধারাবাহিকভাবে। নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান না পেলে এবং নতুন খনি থেকে উত্তোলন শুরু না হলে আগামী আট বছরেই দেশীয় মজুত শেষ হয়ে যেতে পারে।বর্তমানে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দিনে ১৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়। ২০১৭ সালে তা ছিল ২৭০ কোটি ঘনফুটের আশপাশে। অর্থাৎ দেশীয় গ্যাসের উত্তোলন ৩৩ শতাংশ কমেছে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সরকার গ্যাস অনুসন্ধান বাদ দিয়ে আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, এ সরকারেরও অনুসন্ধানের চেয়ে এলএনজি আমদানির দিকে ঝোঁকটা বেশি দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমায় বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানির বিলাসিতা দেখানোর সুযোগ নেই।ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের জন্য বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময়। সম্ভাবনার খুবই ক্ষুদ্র অংশ আবিষ্কৃত হয়েছে। একটা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হলে আরেকটা পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। নীতিনির্ধারকেরা এটি করতে চান না। কোনো সরকার অনুসন্ধানে জোর দেয় না।তিনি বলেন, ব্যাপক হারে অনুসন্ধান চালাতে হবে। সরকারের উচিত দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া। (https://www.prothomalo.com/bangladesh/ekzo6fwph1)

মন্তব্যঃ 

পতিত হাসিনা সরকারের মত অন্তর্বর্তী সরকারও গ্যাসের মজুদ নিঃশেষের এই তথাকথিত আখ্যান প্রচার করছে। কারণ দেশের মূল ভূখন্ডে ও সমুদ্র উপকূলে গ্যাসের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্ভাব্য মজুদ থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের পরিবর্তে দেশকে মৌলিক জ্বালানীর জন্য বিদেশী শক্তির উপর নির্ভরশীল করে রাখার পুঁজিবাদী পলিসি এখনো বলবৎ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে সমৃদ্ধ খনিজে পরিপূর্ণ হাইড্রোকার্বন-বহনকারী পাবলিক গঠনের কারণে বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ গ্যাসপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত। তথাপি এদেশে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় আসা কোন পুঁজিবাদী সরকারই জ্বালানী চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের প্রতি কখনও গুরুত্বারোপ করেনি। ১৯৭৪ সাল থেকে চালু হওয়া বিশ্বব্যাংকের স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রামের (এস.এ.পি) আওতায় তারা মার্কিন ও ব্রিটিশ কোম্পানীগুলোকে উৎপাদন বন্টন চুক্তি (পি.এস.সি)-এর নামে আমাদের গ্যাস সম্পদ লুট করার সুযোগ করে দেয়। উৎপাদন বন্টন চুক্তি অনুসারে উত্তোলিত গ্যাসের সুবিধা দেশের জনগণ খুব একটা ভোগ করেনি কারণ এই চুক্তি অনুসারে উত্তোলিত গ্যাসের ৭৫% নিয়ে যাচ্ছে এসব বিদেশী কোম্পানিগুলো। যদিওবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্স বিদেশী কোম্পানীগুলোর তুলনায় অর্ধেক খরচে দেশের স্থলভাগে অবস্থিত গ্যাসক্ষেত্রসমূহ অন্বেষণ করার ক্ষমতা রাখে, তবুও এই দক্ষ প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এছাড়া দেশের সমুদ্র উপকূলের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস অনুসন্ধানের পরিবর্তে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানী ExxonMobil কে গভীর সমুদ্রের ১৫ টি ব্লক তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। বদরুল ইমামের মত ভূত্বত্ত্ববিদগণ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন যে,  বিশ্বে যেখানে পাঁচটা কূপ খনন করলে একটা গ্যাস ক্ষেত্রে পাওয়া যায়, সেখানে আমাদের দেশে গড়ে প্রায় তিনটা কূপ খনন করলে একটা মেলে। কিন্তু গত ২০ বছরে এদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সরকারসমূহ মাত্র ৩০-৩২ টি অনুসন্ধানমূলক কূপ খনন করেছে এবং সম্ভাবনাময় গ্যাস সেক্টরকে রুগ্ন করে রেখেছে। আর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১০০ কূপ খননের উদ্যোগের কথা বললেও দীর্ঘসূত্রিতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা আটকে রয়েছে (বিস্তারিতঃ পিছিয়ে পড়ছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমঃ ডিপিপি অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা, কালবেলা ২৩ নভেম্বর ২০২৪)। ফলশ্রুতিতে দেশে দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ২০১৭ সালে যেখানে ছিল ২৭০ কোটি ঘনফুটের আশপাশে সেখানে ২০২৫ সালে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ১৮০ কোটি ঘনফুট! অর্থ্যাৎ, গ্যাসের উৎপাদন ক্রমাগতভাবে কমানো হচ্ছে। আর এর প্রকৃত কারণ হচ্ছে, উচ্চমূল্যে (স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত গ্যাসের চেয়ে ৩০ গুণ বেশী ব্যয়বহুল) তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এল.এন.জি) আমদানী করা, যাতে গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও নতুন করে ঢেলে সাজানোর কাজে বিনিয়োগ না করে দেশী-বিদেশী কতিপয় পুঁজিপতিকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ কুক্ষিগত করার সুযোগ দেয়া যায়। এজন্য আমরা প্রত্যক্ষ করলাম যে, অন্তর্বর্তী সরকারও ক্ষমতায় এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্জেন্ট এলএনজি কোম্পানীর সঙ্গে বড় ধরনের এলএনজি আমদানি চুক্তি করেছে। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদার ৩৫% সরবরাহ করা হচ্ছে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে। এই আমদানি নির্ভরতা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ হাইড্রোকার্বন ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যে ভরপুর হওয়া সত্ত্বেও এই ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠীর অবহেলার কারণে আমরা আমাদের মৌলিক জ্বালানি নিরাপত্তার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তাই এসব অজ্ঞ শাসকদের সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন: “আর তুলে দিও না নির্বোধদের হাতে তোমাদের ঐ সম্পদ, যেটিকে আল্লাহ্ তোমাদের জীবন নির্বাহের অবলম্বন বানিয়েছেন …” [সূরা নিসা: ৫]।

 এই ধর্মনিরপেক্ষ সরকারগুলোর হাতে প্রাকৃতিক গ্যাস ও অন্যান্য সম্পদসমূহ নিরাপদ নয় এবং তারা জনগণকে এসব সম্পদসমূহের যথাযথ সুবিধা উপভোগ করতে দেবে না। তেল-গ্যাসের মত মৌলিক জ্বালানী সম্পদের তত্ত্বাবধান এবং জনগণকে এই সম্পদের পরিপূর্ণ সুবিধাভোগী করার জন্য প্রয়োজন একটা দায়িত্বশীল নেতৃত্ব। একমাত্র খিলাফত ব্যবস্থায় শারীআহ্‌ শাসনের ফলে এই দায়িত্বশীল নেতৃত্ব তৈরি হয়। ফলে খিলাফত রাষ্ট্র জনগণের পক্ষে এই সম্পদসমূহ নিজে অথবা ঠিকাদার নিয়োগ করে অনুসন্ধান, উত্তোলন ও তত্ত্বাবধান করে এবং এগুলো থেকে প্রাপ্ত সুবিধাদি সকল নাগরিকদের মধ্যে বিতরণ করে। কারণ শারী‘য়াহ্ বিধান অনুযায়ী তেল ও গ্যাস হচ্ছে গণ-মালিকানাধীন সম্পদ যেগুলো থেকে সকল নাগরিকের উপকৃত হওয়ার অধিকার রয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেন, “মুসলিমগণ তিনটি বিষয়ে অংশীদার: পানি, চারণভূমি এবং আগুন (জ্বালানী)” (ইবনে মাজাহ্)। কোন ব্যক্তি বিশেষকে কিংবা বিদেশী কোম্পানিকে ব্যক্তিগতভাবে এই সম্পদের দখল ও ইজারা দেওয়া ইসলামী শরীয়াহ পরিপন্থী। তাই খিলাফত রাষ্ট্র অবিলম্বে আমাদের প্রাকৃতিক ও গণমালিকানাধীন সম্পদসমূহ বেসরকারীকরণ করার পরিকল্পনা চিরতরে নস্যাৎ করবে এবং আমাদের জ্বালানি খাতে সকল প্রকার উৎপাদন-বটন চুক্তিগুলোকে বাতিল করে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে দেশ থেকে বিতাড়িত করবে। প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অন্যান্য জ্বালানী সম্পদ সমরভিত্তিক শিল্পসহ ভারী শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির অন্যতম উৎস হওয়ায় বাংলাদেশ যাতে তার বিশাল জ্বালানী মজুদ ও তার অপার সম্ভাবনা ব্যবহার করে জ্বালানী সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে পারে তা আসন্ন খিলাফত রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।

    -    কাজী তাহসিন রশীদ


Previous Post Next Post