শাহবাগে বুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশের লাঠিচার্জে আহত ১০

 


খবরঃ 

৩ দফা দাবিতে আন্দোলনরত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ঘটেছে। এ ঘটনায় ২ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। বুধবার (২৭ আগস্ট) দুপুর দেড়টার দিকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে এই ঘটনা ঘটে। ব্যারিকেড ভেঙে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে অগ্রসর হতে চাইলে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো—ইঞ্জিনিয়ারিং নবম গ্রেড বা সহকারী প্রকৌশলী বা সমমান পদে প্রবেশের জন্য সবাইকে নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হবে এবং ন্যূনতম বিএসসি ডিগ্রিসম্পন্ন হতে হবে। কোটার মাধ্যমে কোনো পদোন্নতি নয়, এমনকি অন্য নামে সমমান পদ তৈরি করেও পদোন্নতি দেওয়া যাবে না। টেকনিক্যাল দশম গ্রেড বা উপ-সহকারী প্রকৌশলী বা সমমান পদের নিয়োগ পরীক্ষা ন্যূনতম ডিপ্লোমা এবং একই ডিসিপ্লিনে উচ্চতর ডিগ্রিসম্পন্ন বিএসসিদের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি ডিগ্রি ব্যতীত প্রকৌশলী পদবি ব্যবহারকারীদের বিষয়ে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে (https://www.kalerkantho.com/online/dhaka/2025/08/27/1569061)। 

মন্তব্যঃ 

শাহবাগে প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনা মূলত আমাদের দেশের দীর্ঘস্থায়ী প্রশাসনিক কাঠামোর সংকট ও অসাম্যের বহিঃপ্রকাশ, যা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসন কাঠামোর উত্তরাধিকার বহন করছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা ভারতবর্ষে এমন একটি প্রশাসনিক চাকরির কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছিল, যেখানে যোগ্যতা বা কর্মদক্ষতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো আনুগত্য ও সামাজিক মর্যাদাকে। ফলে প্রশাসনিক পদগুলোতে বিশেষ সুবিধা, উচ্চ বেতন, উন্নত আবাসন, চিকিৎসা ও যাতায়াতের সুযোগ দেওয়া হতো শুধু ওই শ্রেণিকে, যারা ঔপনিবেশিক শাসনের স্বার্থ রক্ষা করত। ফলস্বরূপ, প্রকৌশল, চিকিৎসা বা অন্যান্য বিশেষায়িত দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা যথোপযুক্ত সুযোগ পেত না, বরং তাদের দক্ষতাকে ব্যবহার করা হতো উপনিবেশিক প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার কাজে। এভাবেই চাকরি কাঠামোয় একটি বিভাজন তৈরি করা হয়েছিল, যা আজও আমাদের দেশে বহাল রয়েছে। বর্তমানেও ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া  প্রশাসনিক খাতে একজন সরকারি চাকরিজীবীকে সর্বোচ্চ সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন হিসেবে ধরা হয়। তার বেতন, আবাসন, যাতায়াত, চিকিৎসা ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করা হয় পদের স্ট্যাটাসের ভিত্তিতে, কাজের দক্ষতা বা যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়। এর ফলে, প্রশাসনিক ক্যাডারের সীমিত পদগুলোকে কেন্দ্র করে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে। প্রতিবছর বিসিএস পরীক্ষায় দুই থেকে আড়াই হাজার পদের বিপরীতে প্রায় অর্ধকোটি চাকরি প্রার্থী প্রতিযোগিতা করছে। প্রকৌশলী, ডাক্তার, এমনকি টেকনিক্যাল ডিগ্রিধারীরাও নিজ নিজ পেশা বাদ দিয়ে প্রশাসন, পররাষ্ট্র বা তথ্য ক্যাডারের চাকরির জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, কারণ সেসব পদে রয়েছে অধিক মর্যাদা ও সুবিধা। এই প্রতিযোগিতা থেকেই চাকরি প্রত্যাশীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। চার বছর বা তার বেশি সময় উচ্চতর প্রকৌশল শিক্ষা গ্রহণের পরও যখন একজন বিএসসি প্রকৌশলীকে সীমিত চাকরির জন্য ডিপ্লোমাধারীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়, তখন সেখানে ক্ষোভ, বঞ্চনা এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত জন্ম হয়টা খুবই স্বাভাবিক। অথচ, যদি আমাদের দেশে “ভারীশিল্পভিত্তিক কর্মসংস্থান” গড়ে তোলা হতো, তাহলে দক্ষতার ভিত্তিতে কর্মক্ষেত্র বিভাজন ঘটত। যেমন, উচ্চতর দক্ষতা সম্পন্ন প্রকৌশলী ও গবেষকরা কাজ করত ভারী এবং জটিল শিল্পে, আর কারিগরি জ্ঞানসম্পন্নরা কাজ করত মাঝারি ও স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন শিল্পে। এতে প্রশাসনিক পদে অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা তৈরি হতো না। কিন্তু স্বার্থান্বেষী ধর্মনিরপেক্ষা পুঁজিবাদী শাসকরা শিল্প খাতের উন্নয়ন না করে কেবলমাত্র কিছু প্রশাসনিক পদে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে চাকরি প্রত্যাশীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বিভাজন তৈরি করছে। এই সংকটের মূল কারণ আমাদের দেশের শিল্প ও প্রশাসনিক খাতে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী কাঠামো বজায় রাখা, যা ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী শাসকরা দশকের পর দশক ধরে তাদের হীন স্বার্থে টিকিয়ে রেখেছে।

আমাদের দেশের শিল্প ও প্রশাসনিক খাতে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের শিকড় উপড়ে ফেলতে পারে একমাত্র ইসলামের পরাক্রমশালী খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা। খিলাফত রাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে ইসলামের বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মিলিটারিভিত্তিক ভারীশিল্প কাঠামো গড়ে তোলা। এ লক্ষ্যে খিলাফত রাষ্ট্র দেশের কৌশলগত সম্পদকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দখল থেকে মুক্ত করে ভারীশিল্পের যোগান হিসেবে ব্যবহার করবে। এতে বিভিন্ন স্তরের কর্মসংস্থান তৈরি হবে; যেমন, উচ্চ দক্ষতাসম্পন্নদের জন্য গবেষণা ও প্রযুক্তি খাতে, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্নদের জন্য উৎপাদন ও টেকনিক্যাল খাতে, সাধারণজ্ঞানধারীদের জন্য অতি সহজ খাতগুলোতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ফলে ডাক্তার বা প্রকৌশলীকে প্রশাসনিক চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা করতে হবে না, আবার কারিগরি শিক্ষাপ্রাপ্তরা গবেষণাধর্মী চাকরিতে প্রবেশ করার সুযোগ থাকবে না, কারণ এর জন্য তাদের উচ্চতর দক্ষতার প্রয়োজন হবে। এতে কর্মসংস্থানের স্বাভাবিক বিভাজন ঘটবে, অযৌক্তিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত থাকবে না। উপরন্তু, খিলাফত রাষ্ট্র যেহেতু দ্রুত বর্ধনশীল রাষ্ট্র, এর প্রশাসনিক কাঠামোও হবে বিস্তৃত, যেখানে ব্যাপক লোকবলের প্রয়োজন হবে। ফলে প্রশাসনিক খাতেও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অতএব, ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে শক্তি ক্ষয় না করে আমাদেরকে প্রশাসনিক ও শিল্পখাতে উপনিবেশবাদের লিগ্যাসি বহন করা ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কবর রচনার জন্য বুদ্ধিভিত্তিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কারণ আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে” (সূরা আর-রা‘দ, আয়াত ১১)। 

    -    মোঃ জাফর আহমেদ 


Previous Post Next Post