খবরঃ
আয়নাঘর নামে পরিচিত গোপন বন্দিশালাগুলোর মধ্যে তিনটি পরিদর্শনের পর এগুলোকে ‘ভয়াবহ ও অবিশ্বাস্য’ বলে বর্ণনা করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘বর্ণনা করতে চাইলে বলা যায়, সে এক ভয়াবহ দৃশ্য! সেখানে যা ঘটেছে সবই ছিল ভয়াবহ। আমি যা শুনেছি তা অবিশ্বাস্য! ভাবছি এটাই কি আমাদের পৃথিবী? আমাদের সমাজ?’ ঢাকায় আগে ‘নির্যাতন কেন্দ্র (টর্চার সেল) ও গোপন কারাগার’ হিসেবে ব্যবহৃত তিনটি স্থান পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকর্মী ও কয়েকজন উপদেষ্টাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ‘আয়না ঘর’ পরিদর্শন করেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তারা কিভাবে আল-জাহিলিয়াহ (অজ্ঞতার যুগ) প্রতিষ্ঠা করেছিল— এটি তার নমুনা এটি (https://unb.com.bd/bangla/category/বাংলাদেশ/‘ভয়ংকর-ও-অবিশ্বাস্য’,-আয়নাঘর-পরিদর্শন-শেষে-ড.-ইউনূস/100813)
মন্তব্যঃ
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার-টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন আটক কেন্দ্রের নাম ‘আয়না ঘর’। ২০২৪ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার বছর, ২০০৯ সাল থেকে তার পতন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬০০টিরও বেশি গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে যাদের অধিকাংশকেই এই আয়নাঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছিলো। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও সেক্যুলার মূল্যবোধে ভিন্নমত পোষণকারী কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আয়না ঘরের মত গোপন বন্দিশালায় গুম, নির্যাতন, হত্যা নতুন কোন বিষয় নয়। বিএনপি'র শাসনামলে ২০০৪ সালে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের মোড়ল আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে রাজনৈতিক ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে কুখ্যাত ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গঠন করা হয়েছিল। র্যাব ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ১০৬২ জনকে গোপন বন্দিশালায় নির্যাতন করে এবং ক্রসফায়ারে হত্যা করে (Dhaka Tribune, 19 March, 2017)। ২০২২ সালে আমেরিকা তার সাম্রাজ্যবাদী নীতির কাছে হাসিনাকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করার অংশ হিসেবে র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে র্যাব গঠনে আমেরিকার পরিকল্পনা উন্মোচন করে হাসিনা বলেছিল, “আমেরিকার পরামর্শেই র্যাব সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকাই র্যাবকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। র্যাবের অস্ত্রশস্ত্র, হেলিকপ্টার এমনকি তাদের ডিজিটাল সিস্টেম, আইসিটি সিস্টেম সবই আমেরিকার দেওয়া” (প্রথম আলো, ৬ অক্টোবর, ২০২২)। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মার্কিন দালালগোষ্ঠী হাসিনার গুম-খুনের চিত্র জাতীয়-আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ করলেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকার পরিকল্পনাসমূহ আড়াল করেছে। এমনকি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উগ্রবাদ দমনের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে পুলিশের দুর্বৃত্ত বাহিনী কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি), যা জঙ্গি নাটক তৈরির মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করেছে, এর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগীতার অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী কুখ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) কে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তাছাড়া, আমেরিকা নিজেই আয়না ঘরের মতো কুখ্যাত গোপন কারাগারের জন্মদাতা। উপনিবেশবাদী আমেরিকা মুসলিম দেশগুলোতে তার আধিপত্য বজায় রাখতে এবং ইসলামের শাসনব্যবস্থা খিলাফতের আবির্ভাবকে বিলম্বিত করতে তার দালালগোষ্ঠীর মাধ্যমে নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সচেতন নাগরিক, আলেম-ওলামাকে অপহরণ করে গুয়ান্তানামো বে, বাগরাম, আবু গারিবের মতো গোপন কারাগারে আটক রেখে বছরের পর বছর অমানবিক নির্যাতন পরিচালনা করে আসছে।
তাছাড়া, মুসলিম দেশগুলোতে উপনিবেশবাদী মার্কিন-ব্রিটেনের চাপিয়ে দেওয়া ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ত্রুটি বিচ্যুতি এবং এর জুলুম নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে যেহেতু গণআন্দোলন এবং গণবিদ্রোহ তৈরি হয়, তাই এই শাসনব্যবস্থায় আয়নাঘরের মতো গোপন কারাগারে বন্দি, নির্যাতন, ঘুম-খুন একটি স্বাভাবিক বিষয়। জনগণের টুটি চেপে ধরেই এই ধরণের শাসনব্যবস্থা টিকে থাকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, গণতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে ভিন্নমত পোষণকারীদের জন্য নয়। গুমের স্বীকার বন্দিদের নিয়ে আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে প্রফেসর ইউনুস মায়াকান্না দেখালেও তিনি তার পূর্বসূরী আওয়ামী-বিএনপির চেয়ে ব্যতিক্রম নন। আমরা দেখছি, প্রাথমিকে নিয়োগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক শিক্ষিকাদেরকে পুলিশ দিয়ে নির্মমভাবে দমন এবং গ্রেফতার করছে। বইমেলায় ইসলামবিরোধী বই প্রদর্শনে সাধারণ জনতা প্রতিবাদ করলে তথাকথিত উগ্রবাদ দমনের নামে ইতিমধ্যে তিনিও ইসলামপ্রিয় মুসলিমদেরকে হুমকি দিয়েছেন (বইমেলার স্টলে হট্টগোলের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা, দোষীদের বিচারের নির্দেশ)। সুতরাং গণতন্ত্র যেখানে একটি দুর্বৃত্ত শাসনব্যবস্থা, সেখানে এই ব্যবস্থার সংস্কার তার চরিত্র পরিবর্তন করে না, বরং গণতন্ত্রের দুর্বৃত্তায়ন থেকে নিরাপত্তা পেতে হলে আমাদেরকে ইসলামের ন্যায়নিষ্ঠ শাসনব্যবস্থা নবুয়তের আদলে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, “নিশ্চয়ই ইমাম (খলিফা) হলো ঢালস্বরুপ, যার পিছনে থেকে মুসলিমরা যুদ্ধ করে এবং নিজেদের রক্ষা করে” (সহীহ মুসলিম: ১৮৪১)।
- আবি আব্দুল্লাহ