মিরপুরে বিহারিদের উচ্ছেদ বন্ধে হাইকোর্টের রুল

 



খবরঃ

রাজধানীর পল্লবী থানাধীন মিরপুর ১১’র মিল্লাত ক্যাম্প এলাকায় উর্দুভাষী অধ্যুষিত ২৪টি প্লট উচ্ছেদ ছয়মাসের জন্য স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি উর্দুভাষীদের পুনর্বাসনে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি রুল জারি করেছেন আদালত। মঙ্গলবার বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি মুবিনা আসাফের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই আদেশ দেন। উল্লেখ্য, মিরপুর মিল্লাত ক্যাম্প উচ্ছেদের জন্য জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি নোটিশ জারি করলে স্থানীয় উর্দুভাষী ক্যাম্পবাসীরা প্রতিবাদ জানায়। বাংলাদেশ বিহারী পুনর্বাসন সংসদ (বিবিআরএ ) ও ন্যাশনাল আওয়ামি পাটি বাংলাদেশ (ন্যাপ বাংলাদেশ)’র মহাসচিব নেয়াজ আহমদ খান আমার দেশকে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর অর্থাৎ ১৯৭২ সাল হতেই উর্দুভাষী মুসলিমরা ঘর ছাড়া হয়ে দেশের ১৩ জেলায় বিভিন্ন অস্থায়ী ক্যাম্পে বসবাস করছেন। গত ৫২ বছরে পুনর্বাসনের আশ্বাস দিলেও কোনো সরকারই তাদেরকে পুনর্বাসিত করেনি। খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, সৈয়দপুর, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, নওগাঁ, আদমজী, চট্টগ্রাম, মোমেনশাহী, জামালপুর সহ বিভিন্ন জেলায় ক্যাম্প রয়েছে। ঢাকার মিরপুর ১০,১১, ১২ ও মোহাম্মদপুরে সিংহভাগ উর্দুভাষী বসবাস করেন। বর্তমানে তারা ভোটার এবং বিভিন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠী ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করেন। গাড়ির ড্রাইভার, নাপিত, দারোয়ান, ক্লিনার, বেনারসি শাড়ির কারিগর, গাড়ি মেরামতের মিস্ত্রি, দিনমজুরি প্রভৃতি পেশার মাধ্যমে তারা সংসার নির্বাহ করেন। এদের মধ্যে শিক্ষার হার বৃদ্ধির জন্য কোনো সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আমরা আশা করছি উর্দুভাষীদের পুনর্বাসনে বর্তমান বৈষম্যবিরোধী তত্ত্বাবধায়ক সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।’  (https://dailyamardesh.com/national/amdc9hecetk8w)

মন্তব্যঃ

বাংলাদেশের বিহারী জনগোষ্ঠী, যারা উর্দুভাষী শরণার্থী বা পাকিস্তানি শরণার্থী নামেও পরিচিত, দেশের একটি অবহেলিত জনগোষ্ঠী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এই জনগোষ্ঠী নানা ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। তাদের অনেকেই এখনো বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাস করছে, যেখানে মৌলিক নাগরিক সুবিধার চরম অভাব রয়েছে। বিহারীরা মূলত ভারতের বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িশ্যা থেকে আসা উর্দুভাষী মুসলিম, যারা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) হিজরত করে চলে আসে। ১৯৪৭ সালে যেহেতু ধর্মীয় ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র গঠিত হয়, তাই এই প্রক্রিয়ায় ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। বিহারীরা পূর্ব পাকিস্তানে এসে মূলত শিল্প, ব্যবসা ও সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হলে বিহারী-সহ অন্যান্য অবাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে বিহারীদের একটি কৃত্রিম বিভেদ তৈরি করা হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী নাজুক পরিস্থিতিতে অনেক বিহারী পাকিস্তানে চলে যেতে চায়। কিন্তু পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বও তাদেরকে গ্রহণ করেনি, ফলে তারা বাংলাদেশেই থেকে যেতে হয়। তাদের পরিচয় হয় "পাকিস্তানি শরণার্থী"! অথচ তারা জীবনে কখনো পাকিস্তানে যায়নি, ১৯৪৭ সালের পর থেকে তারা বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডেই বসবাস করছে। বাংলাদেশে বর্তমানে আনুমানিক ৩-৫ লাখ বিহারী যার একটি বড় অংশ এখনো বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে। অধিকাংশ ক্যাম্পে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা নেই, বিদ্যুৎ নেই, স্বাস্থ্যসেবা নেই। পরিবারগুলো ৪-৫ জন মিলে ছোট্ট এক কামরার ঘরে গাদাগাদি করে থাকে। পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভয়াবহ, যার কারণে ক্যাম্পগুলোতে সংক্রামক রোগের প্রকোপ বেশি। শিক্ষার সুযোগ নেই—বেশিরভাগ বিহারী শিশু বিদ্যালয়ে যেতে পারে না।

বিহারী সমস্যার মূল কারণ হলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের রোগ। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর মতাদর্শিক দৈন্যতা ও রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার অভাব এই সমস্যাকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। বুদ্ধিজীবী ও তথাকথিত সিভিল সোসাইটি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের রোগে আক্রান্ত হওয়ায় বিহারীদের ন্যায্য মৌলিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয় না। যারা তথাকথিত "অন্তর্ভুক্তিমূলক" (Inclusive) সমাজ গঠনের নামে LGBTQ, নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষীদেরকে সমাজে স্পেস দেওয়ার কথা বলে, তারাও বিহারী প্রশ্ন নীরব-বোবা-কালা। উচ্চ আদালতের ২০০৮ সালের নাগরিকত্ব রায়ের পরেও সরকার ও রাজনীতিবিদেরা বিহারীদের বিষয়টি সমাধান করেনি। ফলে তারা শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা—সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়ছে।

বিহারী সমস্যার সমাধানের জন্য প্রথম প্রয়োজন জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণতার রোগ থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামী মতাদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের গঠন ও সমাজের বন্ধনকে নিশ্চিত করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আসাবিয়াত (জাতীয়তবাদ, গোত্রবাদ, বংশগৌরব ইত্যাদি)-এর দিকে ডাকে, বা আসাবিয়াতের কারণে লড়াই করে, বা আসাবিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। [সুনানে আবু দাউদ] তাই ইসলামী সমাজে কেউ বাঙালি-অবাঙালি, আরব-অনারব ইত্যাদির ভিত্তিতে বৈষম্যের শিকার হন না। বরং ইসলামের বন্ধনের কারণে একজন মুমিন ওপর একজন মুমিনের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এক মুমিন অপর মুমিনের ভাই। তারা একে অপরকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে রক্ষা করে। [সুনানে আবু দাউদ]

    -    রাশিদ হাসান মাহাদি


Previous Post Next Post