খবরঃ
রাজধানীর আদাবর থানাধীন মেহেদীবাগ এলাকায় এক তরুণীকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এক পর্যায়ে মেয়েটিকে প্রকাশ্যে মারধর করে তারা। এমনকি তরুণীর অভিভাবককে হত্যার হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। পরিবারের আতঙ্কিত সদস্যরা কিছুদিন এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। পরে পুলিশের নিরাপত্তার আশ্বাসে তারা ফিরে আসে। এরপর ওই কিশোর গ্যাং সদস্যদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়। তবে এখনো কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ার পরিবারটি আতঙ্কে রয়েছে। ... পুলিশের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকার মধ্যে আদাবর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সবচেয়ে বেশি, প্রায় দুই হাজার সদস্য রয়েছে। আদাবর এলাকার আলিফ হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং, শেখের টেক ও ঢাকা উদ্যান এলাকার সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া মিরপুর, উত্তরা, পুরান ঢাকার বিভিন্ন মহল্লা, ডেমরাসহ রাজধানীর ৫০টি থানা এলাকায় কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আগের চেয়ে বেড়েছে। গত পাঁচ মাসে দেশের সর্বত্র কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ব্যাপক বেড়েছে। হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতিসহ রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে অর্থের বিনিময়ে ভাড়াটে অপরাধী হিসেবে তারা কাজ করছে। (www.kalerkantho.com/online/national/2025/01/25/1472672)
মন্তব্যঃ
এসব ঘটনা শুধু আইন-শৃঙ্খলার সংকট নয়, এটি সমাজের গভীরে প্রোথিত একটি সাংস্কৃতিক ও নৈতিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয়। এর পেছনে কাজ করছে বহুমুখী কারণ। ঢাকার দ্রুত নগরায়ণে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়েছে; অনেক কিশোর বাবা-মায়ের কর্মব্যস্ততা বা বিচ্ছেদের শিকার। ফুটপাত, স্লাম, বা অর্ধ-গঠিত বস্তিতে বেড়ে ওঠা এসব তরুণের কাছে গ্যাং হয়ে উঠেছে ‘পরিবার। গবেষণা বলছে, মিরপুর-যাত্রাবাড়ির ৬০% গ্যাং সদস্যের পরিবারে পিতা বা মাতা অনুপস্থিত। নীতিভ্রষ্ট স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা ইচ্ছাকৃতভাবে এসব গ্যাংকে পৃষ্ঠপোষকতা দেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর অপরাধীরা। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হলেও কিশোর অপরাধীদের গ্যাং কালচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রতিটি গ্যাংয়ের নেপথ্যেই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মদদ রয়েছে।
এছাড়া, পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন কিশোরদের মননে বিষাক্ত প্রভাব ফেলছে। হলিউডের গ্যাংস্টার মুভি (‘স্কারফেস, স্ন্যাচ, বয়েজ এন দ্য হুড ইত্যাদি), RAP সঙ্গীতের গ্ল্যামারাইজড অপরাধী জীবন এবং সামাজিক মাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ কালচার কিশোরদের মস্তিষ্কে অপরাধকে ‘কুল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ঢাকার এক গ্যাং সদস্য জয় (ছদ্মনাম) বলেছে, “যখন ট্রাভিস স্কটের কনসার্টের ভিডিও দেখি, মনে হয় Gun নিয়ে ঘোরাই তো লাইফ!” ঢাকার মিডিয়া ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এই অপসংস্কৃতির আগুনে ঘি ঢালে। মিডিয়া হাউসগুলো অনবরত প্রচার করছে ‘সাফল্য = গাড়ি-বাংলো-বিলাসিতা’। একটি জনপ্রিয় সাবান বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, একটি গ্যাং লিডারকে ‘হিরো’ বানিয়ে তোলা হচ্ছে! ভাইরাল হওয়ার লোভে টিকটকে কিশোররা আত্মঘাতী স্টান্ট করছে, চুরির ভিডিও পোস্ট করছে। এফএম রেডিওগুলোর ৭০% গানই প্রেম-বিরহের নামে উস্কে দিচ্ছে হিপহপ কালচারের অস্থিরতা। সবাই মিলে কিশোর-তরুণদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাবকে গ্লোরিফাই করে। কিশোর গ্যাং সমস্যা তাই শুধু ‘আইন-শৃঙ্খলা’ ইস্যু নয়, এটি সমাজের মূল্যবোধের দেউলিয়াত্বের প্রতিচ্ছবি। আদর্শহীন রাষ্ট্রে উন্নত জীবন-দর্শনবিহীন শিক্ষা ব্যবস্থা কিশোরদের মনে তীব্র আত্মপরিচয়ের সংকট তৈরি করে। স্কুল-কলেজ যখন পরীক্ষার চাপে নিষ্পেষিত, আর সমাজ যখন তাদের স্বপ্ন দেখায় শুধু ‘ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার’, তখন গ্যাংয়ের সদস্যরা পায় ‘ক্ষমতা’ ও ‘স্বীকৃতি’। গ্যাংয়ে যোগ দেওয়া মানে Power Trip—একটি রুগ্ন সমাজের প্রতিবাদ।
এই সংকট মোকাবিলায় প্রথম প্রয়োজন রাষ্ট্রের সদিচ্ছা, রাষ্ট্রের নিজের মতাদর্শিক পরিবর্তন। রাষ্ট্রের গডফাদার/বড় ভাই কেন্দ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ভিশনহীন শিক্ষাব্যবস্থাকে অটুট রেখে কিশোর গ্যাং কালচার নির্মূল করা যাবে না। এই পশ্চিমা ভোগবাদ আর রাজনৈতিক দুর্নীতির বিষবাষ্প থেকে কিশোর-তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে ইসলামী শিক্ষার আলোয় তাদের মনন গড়ে তুলতে হবে। ইসলাম কখনোই ব্যক্তিগত ‘হিরোইজম’ এর নামে অহংবোধ, হিংস্রতা ও অপরাধপ্রবণতাকে প্রশ্রয় দেয় না। বরং, কিশোর বয়স থেকেই তাদের মধ্যে এমন স্বপ্নের বীজ বপন করা হয় যাতে তারা রাষ্ট্রকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা, প্রযুক্তি, সমরবিদ্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে উৎকর্ষের চরম শিখরে নিয়ে যেতে পারে। এবং যাতে তারা ইসলামী রাষ্ট্রকে বিশ্বের বুকে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলা এবং নির্যাতিত মানবতাকে কুফরের অন্ধকার হতে ইসলামের আলোর দিকে নিয়ে আসতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
- রাশিদ হাসান মাহাদি