মরক্কোর সাধারণ তরুণ থেকে যেভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম পর্যটক হলেন ইবনে বতুতা

 




খরবঃ

দুনিয়া দেখার নেশার সেদিন ঘর ছেড়েছিলেন ২১ বছরের এক মরোক্কান মুসলিম তরুণ। দিনটা ছিল ১৩২৫ সালের ১৩ জুন। তরুণের নাম আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-লাওয়াতি আল-তানজি ইবনে বতুতা। ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকার বিস্তৃত এলাকা থেকে চীন পর্যন্ত ঘুরেছেন, তবে শুধু ব্যক্তিগত বিনোদন তার ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল না। তার প্রথম গন্তব্য ছিল পবিত্র নগরী মক্কা। ধর্মীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞানের প্রতি তার গভীর আগ্রহ তাকে বিচারিক (কাজী) পদের জন্য যোগ্য করে তোলে এবং ভ্রমণের নেশা তাকে আরো বহুদূর নিয়ে যায়। ১৩২৬ সালে হজ্জ পালনের পর তিনি তত্কালীন আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ পরিদর্শন করেন। ১৩২৭ থেকে ১৩৩০ সাল পর্যন্ত ইবনে বতুতা মক্কা ও মদিনায় ইসলামী জ্ঞানার্জনে রত থেকে ধর্মীয় জীবনযাপন করেন। এরপর খোরাসান ও আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে দুর্গম হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে দিল্লী পৌঁছালে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক তাকে কাজী হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৩৪২ সালে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক ইবনে বতুতাকে চীনা শাসকের কাছে তার দূত হিসেবে নিয়োগ দেন। মালদ্বীপেও বিচারক হিসেবে দুই বছর কাজ করেছেন তিনি। ... ইবনে বতুতার চীন সফর মধ্যযুগের বাণিজ্য ও কূটনীতির মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে মানুষকে জানার সুযোগ করে দেয়। তিনি কৃষ্ণ সাগর হয়ে ক্রিমিয়া, উত্তর ককেশাস, রাশিয়ার ভলগা নদীর ভাটি অঞ্চল ও উজবেকিস্তান ভ্রমণ করেন। দূরপ্রাচ্যে তার লম্বা সফর শেষে ইবনে বতুতা ১৩৪৬ সালে সুমাত্রা, মালাক্কা ও পারস্য উপকূল পার হয়ে, বাগদাদ ও সিরিয়া হয়ে মরক্বো ফিরে যান। এরপর স্পেনে মুসলিম শাসনামলের সর্বশেষ চিহ্ন গ্রানাডায় যান তিনি, দুই বছর পর ১৩৫২ সালে সুদান সফর করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মরক্কোর একটি শহরে তিনি কাজী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার লেখায় মধ্যযুগের ইসলামিক বিশ্বের স্বর্ণযুগের বর্ণনা রয়েছে। (https://www.jugantor.com/islam-life/910059)

মন্তব্যঃ

পৃথিবীর ইতিহাসে ইবনে বতুতার ‘আইকনিক’ চরিত্র হয়ে উঠার পিছনে তত্কালীন খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল এবং তিনি মুসলিমদের এক্যবদ্ধ ‘এক উম্মাহর’ প্রতিনিধিত্ব করতেন। খলিফা, তার বিভিন্ন গভর্নর ও অন্যান্য মুসলিম সুলতানদের প্রতিনিধিত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা তার ভ্রমণকে সম্ভবপর করেছিল এবং একাধারে আফ্রিকা, মুসলিম ভারত ও চীনে তার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন ইসলামী শাসনব্যবস্থার অনন্যতা ও বৈশ্বিক সার্বজনীনতা প্রকাশ করে। তিনি এমন এক সময়ে এই অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন যখন পুরো ইউরোপ অন্ধকারে নিমজ্জিত, এমনকি আমেরিকা মহাদেশের অস্তিত্বও তাদের কাছে অজানা ছিল! শাসনকার্য বলতে তারা বুঝত অত্যাচার, লুটপাট, যুদ্ধ আর রাজ্যদখল; যা তাদের পরবর্তী উপনিবেশবাদী চরিত্রের ভীত রচনা করছিল। তিনি ভারত, মালদ্বীপ ও মরক্কোতে এমন সময় কাজী (বিচারক) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন যখন ইউরোপে বিচারবিভাগের কোন অস্তিত্বই ছিল না; রাজা, কাউন্ট, ব্যারন ও বিশপদের বর্বরতার কাছে জনগন ছিল অসহায়। 

ইবনে বতুতার এমন এক সময়ে তিনটি মহাদেশের হাজার হাজার মাইল ভ্রমণ করেছিলেন যখন কোন ধরনের ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হয়নি; পালতোলা জাহাজ ও ঘোড়া-গাধা ছিল তখনকার বাহন। তিনি নি:স্বন্দেহে এডভ্যাঞ্চার-প্রিয় মুসলিম তরুনদের জন্য একজন আদর্শ। মাত্র ২১ বছর বয়সে পবিত্র হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে বের হয়ে ইসলামী ফিকহ শাস্ত্র ও বিজ্ঞান চর্চা করে নিজেকে মুসলিম উম্মাহর সেবার জন্য প্রস্তুত করে তু্লেছিলেন তিনি। তার বিভিন্ন বিপদসংকুল ও এডভ্যাঞ্চারাস ভ্রমনগুলো যেমন তিনি উপভোগ করতেন, ঠিক তেমনি বিচারক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন মুসলিম উম্মাহর প্রতি তার দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধের পরিচায়ক। তিনি যে উদ্দেশ্যহীন ভাবে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিনোদনের জন্য ভ্রমন করেননি তার প্রমান হল তার প্রতিটি ভ্রমনের লিখিত পান্ডুলিপি তিনি মরক্কোর গভর্নরের কাছে জমা দিয়েছিলেন যেখানে ৬০ জন শাসক সহ দুই হাজারের বেশি ব্যক্তির বর্ননা ছিল। মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীন যোগাযোগ বৃদ্ধি, বাদবাকি বিশ্বের সাথে মুসলিমদের বাণিজ্য নেটওয়ার্ক তৈরী, বুদ্ধিবৃত্তিক আদান-প্রদান এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগের অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। বাইজেন্টাইন রাজধানী (কনস্টানটিনোপল) নিয়ে ইবনে বতুতার রেফারেন্স ছিল খুবই স্বচ্ছ ও সঠিক, যা পরবর্তীতে মুসলিমদের কনস্টানটিনোপল বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

কায়াকিং, হাইকিং, ভিডিও-গেমিং, গো-কার্টিং, ওয়াটার ক্যানন, কার ও বাইক রেসিং, ট্রাম্পোলিন, কন্সার্ট, যৌনতা, ড্রাগ ইত্যাদির মধ্যে ‘এড্রেনালিন-রাশ’ খোঁজা এখনকার মুসলিম তরুনরা মূলত পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রের স্বীকার। কাফির পশ্চিমারা এই মুসলিম তরুনদেরকে ‘ফেইক হিরোইজমে’ ব্যস্ত রেখে তাদেরকে পৌরুষহীন করে রাখতে চায়, যেন মুসলিম বিশ্বের উপর পশ্চিমা নিয়ন্ত্রনকে তারা চ্যালেঞ্জ করতে না পারে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মুসলিম তরুনদের সামনে সবচেয়ে বড় এডভ্যাঞ্চার ও হিরোইজমের কাজ হল আমেরিকার নাকের ডগায় বসে এই পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রনের ঘুঁটি মার্কিন দালালগোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ করা এবং তাদের অসহায় চোখের সামনে নবুয়্যতের আদলে খিলাফত প্রত্যাবর্তনের ঘোষণায় শামিল হওয়া। তারপর, ইসলামের সুমহান বানী ও রাষ্ট্রপরিচালনার সর্বশ্রেষ্ঠ সমাধানসমূহের ব্র্যান্ড-এম্বাসেডর হয়ে বীরদর্পে বুক-ফুলিয়ে পুরো পৃথিবীতে বিচরন করা ও জাহেল পশ্চিমাদেরকে সভ্য করে তোলার চেয়ে দু:সাহসীক ও সম্মানজনক কাজ আর কী হতে পারে! সেদিন জমিনের অধিবাসীদের সাথে সাথে আসমানের ফেরেশতারাও এই তরুনদের বন্দনায় মেতে উঠবেন। আর এই দু:সাহসীক ও সম্মানজনক কাজের পুরষ্কারস্বরূপ আখিরাতে ‘আল্লাহ্‌’র দীদার’ লাভের সুযোগ হাতছাড়া করার মত বোকামি কেইবা করতে চায়!

    -    রিসাত আহমেদ


Previous Post Next Post