খবর:
নিউইয়র্ক টাইমস দাবি করেছে, দীর্ঘকাল ক্ষমতাসীন নেতাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বাংলাদেশ যখন একটি অশান্ত রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন ইসলামপন্থী কট্টরপন্থীরা তাদের প্রভাব জাহির করতে ক্রমশ সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছে। (www.dhakatribune.com/bangladesh/377759/ny-times-islamist-hard-liners-gain-ground-in)
মন্তব্য:
এই নিবন্ধটি পুরানো কিন্তু অতি পরিচিত পশ্চিমাদের তথাকথিত “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”-এর নামে “ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” কৌশলের অংশ। তারা সাধারণত এমন কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে উপাত্ত হিসেবে গ্রহণ করে যেগুলোর সাথে সাধারণত (এমনকি তারাও সেটা জানে) ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারা ইসলামের ভিত্তিতে রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিতর্কিত করতে সেগুলোকে ইসলামী দল বা মৌলবাদী মুসলিমদের কাজ হিসেবে চিত্রিত করে। একটি দেশ বা অঞ্চলে ইসলামী রাজনৈতিক প্রকল্প/দাবী যখন পশ্চিমা আধিপত্যকে হুমকির মুখে ফেলে তখন সেটিকে আক্রমনে “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” হচ্ছে তাদের আদর্শ ন্যারেটিভ। আমাদের সবার মনে আছে আইএসআইএস-এর কথা? আমরা সবাই জানি, আইএসআইএসের পেছনে কারা ছিল এবং কারা তাদের তৈরি করেছে। এটি ছিল এমন একটি অপচেষ্টা যাতে মহিমান্বিত ইসলামী খিলাফতের নাম এবং ধারণাকে বদনাম করা যায়, যা বিশ্ব সভ্যতাকে (ন্যায়বিচার, শান্তি এবং উদ্ভাবনী দ্বারা) এক সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছে! তাই এই নিবন্ধটি যে ভুল তথ্য, হলুদ সাংবাদিকতা এবং অসাধু বর্ণনায় পরিপূর্ণ তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার দরকার নেই। বরং, লেখক যে মূল্যবোধগুলো প্রস্তাব করেছেন এবং বাংলাদেশীরা যেন তা আকাঙ্খা করে এই আশা করেছেন তার উপর আলোকপাত করা যাক।
তারা দাবী করে, ইসলাম বা ইসলামী রাজনৈতিক প্রকল্পগুলো জাতিগত সংখ্যালঘু, নারীর অগ্রগতি, স্থিতিশীলতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা ইত্যাদির জন্য হুমকি; এবং সেক্যুলার পুঁজিবাদের পশ্চিমা মডেল সর্বোত্তম জীবনব্যবস্থা। কিন্তু, তাদের এই দাবীর উত্তরে এক বাক্যে বলা যায়: আসুন দেখি পশ্চিমা গণতন্ত্র সেসব দেশের অবস্থা কি করেছে যেসব দেশ এই প্রেসক্রিপশন নিয়েছিল:
জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের ক্ষেত্রে বলা যায়: ধর্মনিরপেক্ষতার জন্মভূমি খ্যাত দেশগুলোতে এর অবস্থা ভয়াবহ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যে, ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুরা প্রায়শই তাদের জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য গুরুতর বৈষম্য, নিপীড়নের সম্মুখীন হয় এবং এমনকি তাদের হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপতির আসনে বসে ট্রাম্প নিজেই প্রকাশ্যে বলেছে মুসলিমরা খারাপ এবং সে তাদের উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করবে এবং বলেছে "মেক্সিকানরা ধর্ষক"। সেখানে বিদ্যমান বর্ণবাদী আইন (জাতিগত প্রোফাইলিং, ইত্যাদি), শ্বেতাঙ্গ ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে আয়ের ব্যবধান। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, জর্জ ফ্লয়েড, ইত্যাদি ঘটনা। ইউরোপে ইসলামী অনুশীলনগুলো সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ এবং আক্রমণ করা হয়েছে (নিকাব, হিজাব, ইত্যাদি)। নিউজিল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্চ শুটিং এর মত ঘৃণার ঘটনা ঘটেছে। গাজার সাম্প্রতিক পশ্চিম-অনুমোদিত জাতিগত নির্মূলতো বিশ্ববাসীর চোখের সামনে ঘটেছে।
নারীর অধিকার বা সুযোগের ক্ষেত্রে বলা যায়: আসুন দেখি তারা তাদের মহিলাদের সাথে কীভাবে আচরণ করে; ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা এবং গৃহঅভ্যন্তরে নির্যাতনের হার তাদের সেক্যুলার সিস্টেমের মুখোশ খুলে দিয়েছে। MeToo আন্দোলনের কথা সবার মনে আছে। বৃটিশ পুলিশ নগণ্য একটি ফুটবল ম্যাচে হারের কারণেও গৃহঅভ্যন্তরে নারী সহিংসতার উদ্বেগজনক বৃদ্ধির আশঙ্কা করে। একই ধরনের কাজ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে পুরুষ ও মহিলা কর্মীদের মধ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য আয়/বেতনের ব্যবধান। এই পশ্চিমা দেশগুলো গাজায় ছোট মেয়ে ও শিশুদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাতে ইসরাইলকে সাহায্য করছে, যেখানে তাদের পোশাক প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে, তাদের বন্দী করা হচ্ছে, ধর্ষণ করা হচ্ছে, ক্ষুধার্ত করা হচ্ছে এবং নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। এই পশ্চিমা দেশগুলো IMF বা WB এর রক্তচোষা নীতির মাধ্যমে কত দরিদ্র নারীকে শোষণ করেছে? ইরাক, আফগানিস্তান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে তাদের যুদ্ধে কতজন নারী ও শিশু নিহত হয়েছিল? একজন রাষ্ট্রপতি তার মহিলা সহকর্মীকে (মনিকা লিউনিস্কি) যৌন হয়রানী করে এবং তারপর পার পেয়ে যায়, এবং এটি অবশ্য প্রথম বা শেষবার নয়। তাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতি নারীদের সম্পর্কে অশ্লীল মন্তব্য করে এবং তারপরও দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়। এই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ/ব্যবস্থা কর্তৃক মহিলাদের সাথে আচরণের ধরণ।
বাক স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে বলা যায়: মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে ড্রোন হামলার মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে। সারাবিশ্বে টর্চার চেম্বার এবং ব্ল্যাক সাইট (গুয়ানতানামো বে, আবু গারিব কারাগার, ইত্যাদি)। এই টর্চার চেম্বার থেকে অপহৃত ব্যক্তিদের ফাঁস হওয়া ছবি এবং সাক্ষ্য সারাবিশ্বকে হতবাক করেছে। গাজায় ইসরায়েলী গণহত্যার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদগুলোকে কঠোরভাবে দমন করা/গ্রেপ্তার করা/অনেককে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। আপনি সেখানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবেন না, কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ), কুর‘আনকে অপমান করতে পারেন! সংখ্যালঘু এবং ধর্মীয় অধিকারের কথা তাদের ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু না। সারাবিশ্বে অত্যাচারী স্বৈরশাসকদের সমর্থন করা তাদের স্বাভাবিক নীতি; রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট উভয়ই সৌদীর মোহাম্মাদ বিন সালমানের মত কুখ্যাত স্বৈরশাসকের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আছে, যে কিনা সাংবাদিক জামাল খাশোগির প্রকাশ্য হত্যাকারী।
স্থিতিশীলতা এবং বিশ্ব শান্তি ক্ষেত্রে বলা যায়: খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু হামলা চালিয়ে আনুমানিক দুই লক্ষ বেসামরিক লোক মারা গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইতালি বিশ্বকে উপনিবেশ ও লুণ্ঠন করেছে। তারা এবং ইসরায়েল, ইন্ডিয়ার মত তাদের আঞ্চলিক দোসররা বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা ও ধ্বংসের কারণ। তারা বিশ্বকে দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম, কোরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান ইত্যাদিতে অন্যান্য বড় যুদ্ধ উপহার দিয়েছিল এবং বৈধভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোকে পতন এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যে অত্যাচারী শাসক বসানোর ষড়যন্ত্র করে আসছে। মিথ্যার উপর ভিত্তি করে ইরাকে এক মিলিয়নেরও বেশি লোক হত্যা করেছে এবং কাউকে দায়ী করা হয়নি। তারা তাদের তথাকথিত আন্তর্জাতিক আইন দিয়ে বিশ্বকে জিম্মি করে রেখেছে।
সুতরাং, ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ বা ব্যবস্থা ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রীতি, নারী, রাজনৈতিক অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই ইসলামের পুনর্জাগরণে ভীত পশ্চিমা ভন্ড সংবাদপত্রের একটি নিবন্ধ নিয়ে আমাদের হীনমন্যতায় ভোগা উচিত নয়। বরং আমাদের উচিৎ এই ভন্ডদের ডেকে আনা এবং তাদের বস্তাপঁচা ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও ঘৃণ্য কাজগুলো সারাবিশ্বকে দেখিয়ে বলা যে- they are the “sick men" of the world. সুতরাং, একটি পরিবর্তন জরুরী। ইতিহাস আমাদের দেখায় যে শুধুমাত্র একটি সত্যিকারের ইসলামী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাই এই মন্দ আদর্শকে প্রতিস্থাপন করতে পারে এবং বিশ্বকে সুস্থ করতে পারে। আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং মানবজাতির জন্য ইসলামের সমাধান/বার্তা সম্পর্কে জানা উচিত।
- মোহাম্মদ যুবায়ের