ডলারের দর বাজারের উপর ছেড়ে দিল বাংলাদেশ ব্যাংক



খবরঃ

বৃহস্পতিবার থেকে উন্মুক্ত অর্থনীতির নিয়মে বাজারই মুদ্রা বিনিময় হার ঠিক করবে। ব্যাংকগুলো যেকোনো দরে ডলার বিক্রি করতে পারবে। সর্বশেষ গত ২৯ মে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের বিনিময় হার ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, বৃহস্পতিবার তাও তুলে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওপেন মার্কেট অনুযায়ী ডলারের দাম ঠিক হবে। এটা না করলে রেমিটেন্স কমে যাবে বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন। বাজারের উপর ছেড়ে দিলেও বাংলাদেশ মনিটরিং করবে।” (https://bangla.bdnews24.com/economy/article2069910.bdnews)

মন্তব্যঃ

“প্রয়োজনে আইএমএফ থেকে বের হয়ে আসবো”- বলার মাত্র দুই সপ্তাহ পর আইএমএফ-এর শর্তানুসারে ডলারের দর বাজারের উপর ছেড়ে দিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। “ক্রলিং পেগ” থেকে বের হয়ে “ফ্লোটিং এক্সেঞ্জ রেট” এ প্রবেশকে সঠিক কিংবা অর্থনীতির জন্য ভালো সিদ্ধান্ত বলে ধরা হলেও প্রকৃত অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অন্য কথা বলে। প্রথমত, ফ্লোটিং এক্সেঞ্জ রেটে দেশীয় মুদ্রার উপর খুব বেশি প্রভাব পড়বেনা বলে যে কথা বলা হচ্ছে তা বাস্তবিক নয়। কারণ, বর্তমান পুঁজিবাদী কাগুজে মুদ্রা ব্যবস্থায় দেশীয় মুদ্রা ডলারের সাথে ট্যাগ করা থাকায় প্রকৃতপক্ষে ডলারের ডিমান্ড বাড়ার সাথে সাথে দেশীয় মুদ্রার মান পড়া শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের জানুয়ারীতে আইএমএফ-এর চাপে পাকিস্তান যখন তার ডলারের রেট বাজারের উপর ছেড়ে দেয় তখন কয়েকদিনের মধ্যেই পাকিস্তানী রুপির বিপরীতে ডলারের দাম ২৩০ থেকে ২৬০-২৭৫ এ পৌঁছায়। অর্থাৎ, এক সপ্তাহের মধ্যে ১০-১৫% অবমূল্যায়ন ঘটে। যা পরবর্তীতে ৩৬০ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। একইভাবে, আইএমএফ এর চাপে শ্রীলংকাও ২০২২ সালে ডলার রেট বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে শ্রীলংকান রুপি ডলারের বিপরীতে ২০০ থেকে বেড়ে ২৮০-২৯০ তে পৌঁছায়। যেখানে দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন রেট ছিল ৪০-৫০%। বাড়তে বাড়তে একসময় এটি ৪০০ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। দ্বিতীয়ত, ডলারের রেট বাজারের উপর ছেড়ে না দিলে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার খোঁড়া যুক্তি দেয়া হচ্ছে। কেননা, ডলারের রেট বাজারের উপর ছেড়ে দিলে একদিকে অর্থ পাচারের পরিমাণ যেমন বাড়ে, আবার অন্যদিকে প্রবাসীরাও অতিরিক্ত মুনাফার আশায় রেমিট্যান্স ধরে রাখবে বাজারে ডলারের দাম বাড়ার অপেক্ষায়। ফলে, রেমিট্যান্সের স্বাভাবিক সরবরাহও ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। সুতরাং, এধরনের গুরুত্বপূর্ণ পলিসি পরিবর্তনের সময় শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে যে বক্তব্য দেয়া হয় তাতে অনেক সত্যই লুকানো হয় কিংবা প্রকৃত সত্যকে আড়াল করা হয়।

মূলত, কোন দেশকে “ফ্লোটিং এক্সেঞ্জ রেট”-এ নিয়ে যাওয়ার আগে আইএমএফ উক্ত দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এমনভাবে পরিবর্তন করতে বাধ্য করে যেন স্বাভাবিকভাবেই ডলারের আধিপত্য আরো বেশি শক্তিশালী হয়। কেননা, আমেরিকান সংস্থা আইএমএফ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস কনফারেন্সে যেখানে আমেরিকা বিশ্বব্যাপী দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত স্বর্ণভিত্তিক মুদ্রা ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে ডলারভিত্তিক মুদ্রা ব্যবস্থার প্রণয়ন করে, যার মূল উদ্দেশ্য ডলারের আধিপত্য ধরে রাখা। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আইএমএফ একটি দেশকে ১০টি শর্তপূরণে বাধ্য করে। যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে এই “ফ্লোটিং এক্সেঞ্জ রেট”। একদিকে আইএমএফ-এর শর্তানুসারে দেশে অতিরিক্ত ফরেন ইনভেস্টমেন্ট বাড়ানো হয়, অন্যদিকে ডলারের মূল্য বাজারে ছেড়ে দেয়ার মাধ্যমে ডলারকেই শক্তিশালী করা হয়। কেননা, ফরেন ইনভেস্টমেন্ট যখন অবকাঠামো উন্নয়ন সহযোগীতার নামে ফাইন্যান্সিয়াল লোন আকারে আসে তখন স্বাভাবিকভাবেই সুদ এবং প্রিন্সিপাল লোন পরিশোধ করার সময় ডলারের ডিমান্ড বাড়ে। আবার, বিদেশী কোম্পানীর ব্যবসায়িক ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে আসলে যখন কোম্পানীগুলো তাদের মুনাফা নিজ দেশে পাঠাবে কিংবা ইনভেস্টমেন্ট উঠিয়ে নিবে তখনও ডলারের ডিমান্ড বাড়বে। এছাড়াও বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিল্পখাতই বিদেশী কাঁচামালের উপর আমদানীনির্ভর শিল্প। সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই এই পরনির্ভর শিল্পখাতের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ডলারের ডিমান্ড দিন দিন বাড়বেই। তাই, স্বাভাবিকভাবেই ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমে তুরস্ক, পাকিস্তান কিংবা শ্রীলংকার মত একটা ভয়াবহ অর্থনৈতিক ধসের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। যাতে দিনশেষে লাভবান হবে আমেরিকান ডলার এবং বিদেশী কোম্পানীগুলো।

প্রকৃত সত্য হচ্ছে, সেকুলার শাসকগোষ্ঠী আমাদেরকে কখনোই পশ্চিমা আধিপত্য থেকে বের হতে দিবেনা। ইতিমধ্যে “ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট” এর পাশাপাশি বর্তমান সরকার আইএমএফ এর শর্তানুসারে করের বোঝা বৃদ্ধিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুই ভাগে আলাদা করেছে। সুতরাং, এই অবশ্যম্ভাবী ভয়াবহ বাস্তবতা থেকে বের হতে আমাদের অর্থনীতিকে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে বের করতে একটা সামগ্রিক সিস্টেমেটিক পরিবর্তন আনা দরকার। যা সম্ভব মূলত, ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কেননা, একমাত্র ইসলামের অর্থনীতির রয়েছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিপরীতে শক্তিশালী অবকাঠামো। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, “আর যদি সেসব জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত, তাহলে অবশ্যই আমরা তাদের জন্য আসমান ও জমীনের বরকতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম” (সুরা: আরাফ: ৯৬) 

    -    আসাদুল্লাহ্‌ নাঈম


Previous Post Next Post