খবরঃ
কোভিডের অর্থবছর বাদ দিলে দেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমেছে গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে। বিনিয়োগও এখন এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। টানা তিন অর্থবছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশে। ১৯৮৬ সালের পর দেশে কখনোই টানা তিন বছর মূল্যস্ফীতি এত বেশি ছিল না। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির তুলনায় টানা ৩৯ মাস ধরে কম, ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। বিনিয়োগ স্থবিরতায় কর্মসংস্থান কমে গেছে সব খাতে, বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। কৃষি উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি এখন গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এতে খাদ্য নিরাপত্তাও শঙ্কার মধ্যে। আর্থিক খাত এখনো ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ব্যাংকের পরিস্থিতি নাজুক। বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। (www.prothomalo.com/business/economics/12pxmojezw)
মন্তব্যঃ
অর্থনীতির এই মন্থরতা কি কোন প্রাকৃতিক কারণে তথা ঝড়, বন্যা, খরা, মহামারী ইত্যাদি কারণে হচ্ছে? নতুবা যুদ্ধ বিগ্রহ, কিংবা প্রযুক্তি না থাকা, দুর্নীতি, সঠিক দক্ষ ও জ্ঞানী লোক না থাকা কিংবা মানুষ কর্মবিমুখ হয়ে গেছে এসব কারণে হচ্ছে? মোটেই না। এসব কারণে হলে বছরের পর বছর, দশকের পর দশক একই প্রবণতা থাকতো না; সরকার পরিবর্তন হলেও এমনকি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মহাদেশে একই রকম চিত্র থাকতো না। বরং, উপরে উল্লেখিত সববিষয় ইতিবাচক থাকার পরও অর্থনীতি খারাপ হওয়া, মৌলিক চাহিদা অপূর্ণ থাকা, ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা বেড়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থাগত কারণ আছে। দেশের এবং বিশ্বের সকল অর্থনৈতিক সুচকগুলো এটা নিশ্চিত করে যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত মানুষের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব কেড়ে নিচ্ছে।
এই ব্যবস্থার সুদ ভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যবস্থা সাকিং মেশিনের মত বেশীরভাগ মানুষের কাছ থেকে টাকা বা সম্পদ শুষে পুঁজিপতি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক, পেশাজীবি, তরুণ উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের জন্য, বড় কর্পোরেট এমনকি সরকারের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয় এবং স্বভাবতই তারা তাদের সাথে পেরে উঠে না। পুঁজিবাদের মুদ্রা ব্যবস্থা যেহেতু ‘ফিয়াট’ তথা কাগুজে মুদ্রা, তাই সরকার প্রতিনিয়ত টাকা ছেপে বাজারে মূল্যস্ফীতি ঘটায় যা মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে কেটে ফেলে। এই ব্যবস্থায় জনগণের জন্য অতীব জরুরী সম্পদগুলো ‘বেসরকারীকরণ’ করা হয়। ফলে জ্বালানী, বিদ্যুৎ, পানি, ইন্টারনেট, এমনকি ব্রিজ, হাইওয়ে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বড় বড় দেশী-বিদেশী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এসবের ফলে সারা বিশ্বের অর্থনীতি ক্ষুদ্র সংখ্যক ট্রিলিয়নিয়ার-বিলিয়নিয়ার এবং ক্ষমতাধর দেশের মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। এই বাস্তবতার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে ‘ট্রাম্প ট্যারিফ’। বিশ্বের প্রায় সকল দেশের উপর অযৌক্তিক ভাবে একধরণের মাস্তানী ট্যাক্স বা ডিউটি আরোপ করার পরও কোন দেশই ট্রাম্পকে কোন নৈতিক প্রশ্নে ফেলতে পারেনি। ট্রাম্প এবিষয়ে দম্ভ করে বলেছে, “Countries are kissing my ass to make trade deals”। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা বিশ্বের মানুষগুলোকে এবং দেশগুলোকে এমন অবমাননাকর লজ্জাস্কর অবস্থায় নিয়ে এসেছে!
অন্যদিকে, ইসলামী ব্যবস্থা তথা খিলাফত, দেশকে আত্মনির্ভরশীল ও নেতৃত্বশীল অর্থনীতির একটি অবস্থানে নিয়ে যায়। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সুদকে করেছেন হারাম আর ব্যবসাকে করেছেন হালাল এবং নির্দেশ দিয়েছেন, “…যাতে ধন-সম্পদ কেবলমাত্র তোমাদের মধ্যকার বিত্তশালীদের মাঝেই আবর্তিত না থাকে…” [সুরা হাশর ৭]। ফলে, খিলাফত ব্যবস্থা ফান্ড বা অর্থ যাতে চলমান থাকে সেটা নিশ্চিত করে। যার দক্ষতা আছে, যে কাজ করতে চায়, সে বিনিয়োগ করার জন্য অর্থ পায়। ইসলাম খলিফাকে তার জনগণের উপর দায়িত্বশীল করে দেয়, ফলে তিনি শারীয়াগতভাবে এই দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ থাকেন যাতে তিনি তার নাগরিকদেরকে অর্থনৈতিকভাবে সার্বভৌম হওয়ার জন্য দক্ষ করে গড়ে তুলবেন। আল্লাহ্’র দেয়া সম্পদগুলো যাতে মানুষরা সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করতে পারে, তিনি তা নিশ্চিত করবেন। যেমন, কৃষির ক্ষেত্রে বিনামূল্যে সার, বীজ, সেচ ইত্যাদি দিবেন। ইসলাম জ্বালানী, বিদ্যুৎ, পানি, ইন্টারনেট ইত্যাদি অতিগুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহকে ‘গণমালিকানাধীন’ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে এবং এসবের ‘বেসরকারীকরণ’ বা লাভগ্রহণ নিষিদ্ধ করে। জনগণের নিয়োগকৃত খলিফা জনগণের জন্য এই সম্পদগুলোর ব্যবস্থাপনা করে। ইসলামের মুদ্রা ব্যবস্থা ‘বাইমেটালিক’ অর্থাৎ স্বর্ণ রৌপ্য ভিত্তিক ফলে এই ব্যবস্থায় প্রক্রিয়াগত মূল্যস্ফীতির কোন সুযোগ নাই। সর্বোপরি প্রতিটি ব্যক্তির অর্থনৈতিক মর্যাদার সুরক্ষা ইসলামের একটি পবিত্র ইমানী দায়িত্ব। আলী (রা) খলিফা থাকাকালে বলেছিলেন, “দারিদ্রতা যদি কোন মানুষ হতো তাহলে আমি তাকে হত্যা করতাম”।
- মোহাম্মদ তালহা হোসেন