“ঈদের হাসি এবং গাজার কান্নার মাঝে: মুসলিম উম্মাহ্’র প্রতি আহ্বান”
(অনুবাদকৃত)
যখন মুসলিমরা ঈদুল আযহাকে স্বাগত জানাতে এবং তাদের সন্তান ও স্ত্রীদের সাথে উদযাপন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন আমরা এই বার্তাটি বিশেষভাবে মুসলিম সেনাবাহিনীর নিষ্ঠাবান অফিসার ও সৈনিকদের এবং সাধারণভাবে উম্মাহ্’র প্রতি নির্দেশ করছি। আমরা এই দিনগুলোতে তাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, তারা ফিলিস্তিন এবং গাজার পবিত্র ভূমিতে তাদের নিজস্ব জনগণ, নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং পুরুষদের পরিত্যাগ করেছে এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি।
আমরা আপনাদেরকে প্রকৃত সামরিক কমান্ডার এবং মহান বীর, সালাউদ্দিন আল-আইয়ুবীর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, যিনি আল-কুদসের পতনের (৫৮৩ হিজরি / ১১৮৭) পরে হাসতে পারেননি এবং শোকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এ সময় তিনি বলেন, “আমার কষ্ট কতটা গভীর, যখন আমি ইসলামের শহরগুলোকে একের পর এক পতিত হতে দেখছি”। এমনকি হিত্তিনের যুদ্ধের পর ক্রুসেডারদের কাছ থেকে আল-কুদস পুনরুদ্ধার করার পরেও, তিনি “মলিন মুখ নিয়ে” শহরে প্রবেশ করেছিলেন এবং সেই মহান বিজয়ে আনন্দিত হননি, বরং দুঃখিত ছিলেন। তাকে তার দুঃখের কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তর দেন, “এই শহরে যখন মুসলিমদেরকে গণহত্যা করার এত বড় ট্র্যাজেডি ঘটে গেছে তখন আমি কীভাবে আনন্দ করব? মুসলিমরা এখানে যা সহ্য করেছে তার জন্য হৃদয়ে ব্যথা নিয়ে আমি কীভাবে হাসব?” তিনি আল-কুদসের মুক্তি (তাহ্রীর)-কে একটি শরীয়াহ বাধ্যবাধকতা হিসাবে দেখেছিলেন, কোনও অনুগ্রহ বা বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্ব হিসাবে নয়। তার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ছিল মুসলিমদের পবিত্র স্থান এবং পবিত্র স্থানগুলো রক্ষা করা; বিজয় নিয়ে গর্ব করা নয়।
এই ছিল সালাহউদ্দিনের অবস্থান, আল-কুদসের মুক্তি (তাহ্রীর) এর আগে এবং পরে তার অবস্থা। আমরা জিজ্ঞাসা করছি: হে অফিসার ও সৈনিকরা, আপনাদের অবস্থা কি আপনাদের আদর্শ সালাহউদ্দিনের মতো? নাকি আপনারা আপনাদের সন্তান এবং স্ত্রীদের সাথে দেখা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, আনন্দে তাদের সাথে ঈদের ছুটি উপভোগ করার জন্য, যেন গাজায় যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে, তা লাহোর, ঢাকা বা কায়রোর কোনও অজ্ঞাত পশু কসাইখানায় ঘটছে?
যদি আপনাদের অবস্থা সালাহউদ্দিনের মতো হয়, তাহলে কীভাবে আপনারা স্ত্রীদের সাথে বিছানায় শুয়ে থাকাকে উপভোগ করতে পারেন, যেখানে ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে প্রথম কিবলা এবং তৃতীয় পবিত্র মসজিদের জন্য সালাহউদ্দিন যা করেছিলেন তার একভাগও করতে ব্যর্থ হন? আর যদি আপনারা বলেন, “আমরা কীভাবে নিজেদেরকে এত মহান ব্যক্তিদের সাথে তুলনা করতে পারি?” তাহলে আপনি কি তাদের মধ্যে একজন হিসেবে গণ্য হবেন না, যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্র করেছে, যারা ইহুদিদের সাথে জোট বেঁধেছে এবং তাদের সমর্থন করেছে? তাহলে আপনি কি জালেম ফেরাউনের সৈন্যদের মতো হবেন, যেমন আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) তাদের বর্ণনা করেছেন, “নিশ্চয়ই ফেরাউন, হামান এবং তাদের সৈন্যরা পাপী ছিল।” [সূরা আল-কাসাস ২৮:৮]। আপনি কি তাদের সাথে জাহান্নামে পুনরুত্থিত হতে পেরে সন্তুষ্ট হবেন? আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করুন!
প্রিয় ভাইয়েরা, আপনারা সালাহউদ্দিনের মতোই। তিনি কোন নবী (আঃ) বা বাদশাহদের মধ্য হতে কেউ ছিলেন না। তিনি আপনাদের মতোই একজন মানুষ ছিলেন, যিনি আপনাদের মতোই বিশ্বাস করতেন এবং আপনাদের মতোই আল্লাহ্’র কাছ থেকে সাহায্য আশা করতেন। তাই কাপুরুষ শাসকদের ফিসফিসানিতে কান দিবেন না, যারা তাদের আখেরাতকে ক্ষণস্থায়ী, প্রতারণামূলক পার্থিব জীবনের জন্য বিক্রি করে দিয়েছে।
শহীদদের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুসলিমদের শোক এবং পরবর্তী অভিযান কেবল সেনাপতি এবং সৈন্যদের মধ্যে মুজাহিদদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি সমগ্র জনগণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহাসিকরা লিপিবদ্ধ করেছেন যে, উত্তর আফ্রিকা এবং আস-শামের মুসলিমরা আল-আন্দালুসের পতনের শোকে বহুদিন ধরে আনন্দ উদযাপন করা থেকে বিরত ছিল। আল-কুদসের পতন এবং আল-মসজিদ আল-আকসায় গণহত্যার পর, সমগ্র ইসলামী বিশ্বে শোক ছড়িয়ে পড়ে এবং মুসলিমরা বিবাহ বা উদযাপন করতে অস্বীকৃতি জানায়। এমনকি উসমানী খিলাফতের (উসমানীয় খিলাফতের) সুলতানরাও ইউরোপের কিছু শহর হারানোর পর প্রাসাদে উদযাপন নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং সরকারী শোক ঘোষণা করেছিলেন। জানা যায় যে, সুলতান (প্রথম) সেলিম বলতেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের ভূমি হুমকির মুখে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত খাবারে কোন স্বাদ নেই, ঘুমে কোন বিশ্রাম নেই এবং হৃদয়ে কোন আনন্দ নেই!”
এই উদাহরণগুলো দেখায় যে, মুসলিমদের জমি হারানো, তাদের পবিত্রতা লঙ্ঘন এবং তাদের নর-নারী হত্যার জন্য দুঃখ করা ঈমানের অংশ। অতীতের উলামা ও শাসকরা কষ্টের সময়ে আনন্দ করাকে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা), তাঁর রাসূল (সাঃ) এবং মু‘মিনদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করতেন। তাহলে সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে জঘন্য জাতি ইহুদিরা, বরকতময় ফিলিস্তিনে যা করছে, তা প্রত্যক্ষ করেও যারা বিশ্বাসঘাতকতা ও নীরবতা অবলম্বন করছে সেটাকে কী বলা যায়?
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) সত্য বলেছেন যখন তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি মুসলিমদের বিষয়ে চিন্তা করে না সে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা), তাঁর রসূল (সা.), তাঁর কিতাব, মুসলিমদের নেতা এবং সাধারণ মুসলিমদের জন্য নিষ্ঠাবানভাবে চিন্তা করে দিন শুরু ও শেষ করে না, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।” [হাদিস: আল-তাবারানী]
আপনারা নিশ্চয়ই ডক্টর আলা আল-নাজ্জারের গল্প শুনেছেন এবং দেখেছেন, যে বোন তার নয়টি সন্তান এবং স্বামীকে হারিয়েছেন কাপুরুষোচিত অপরাধী ইহুদিগোষ্ঠীর বিমান হামলায়। তাহলে ঈদের সময় আমরা কিভাবে খাবারে আরাম পেতে পারি, অথবা স্ত্রীদের সঙ্গ উপভোগ করতে পারি, যেখানে ডক্টর আলা তার হৃদয়ের টুকরোগুলোই হারিয়েছেন? আপনারা কি জানেন না যে, গাজায় ডক্টর আলা'র মতো হাজার হাজার মা আছেন, যারা গত দুই বছর ধরে তাদের সন্তান ও প্রিয়জনদের হারানোর শোকে পাথর হয়ে পড়েছেন?
খলিফা আল-মু‘তাসিমের জন্য আমুরিয়ায় (বর্তমান তুরস্কের একটি অংশ) একজন মহিলার কান্না শুনাই যথেষ্ট ছিল, যিনি “হে মু'তাসিম!” বলে ডেকেছিলেন, এবং সাথে সাথে সেই একজন মহিলাকে সাহায্যের জন্য একটি সেনাবাহিনী তৈরি হয়েছিল। আল-হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের জন্য সিন্ধুর (বর্তমান ভারত উপমহাদেশ) নারীদের দুর্দশার খবর পাওয়া যথেষ্ট ছিল, যারা অত্যাচারী রাজা দাহির শাহের হাত থেকে সুরক্ষা চাইছিল, তাই তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী পাঠান, যারা রাজাকে হত্যা করে এবং সম্মানিত মুসলিম নারীদের অসম্মানের প্রতিশোধ নেন। তাহলে আল্লাহ্’র কসম, এক্ষেত্রে আপনাদের উত্তর কী, যখন ফিলিস্তিনের সম্মানিত ও সম্ভ্রান্ত নারীদের কাছ থেকে হাজার হাজার কান্না আপনাদের নিকট পৌঁছেছে? খাবার, পানীয় বা ঘুম কীভাবে আপনাকে সান্ত্বনা দিতে পারে?
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সীরাতে (জীবনী) এবং খুলাফায়ে রাশিদুনের যুগে বর্ণিত আছে যে, নারীরা তাদের স্বামীদের কাছ থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখতেন, হয় তাদেরকে যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করার জন্য, অথবা তাদের কাপুরুষতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য। তাবুক অভিযানের সময়, কিছু মহিলা তাদের স্বামীদের সাথে ঘনিষ্ঠতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যদি তারা যুদ্ধে যোগ দিতে দ্বিধা করত। একজন মুসলিম নারী তার স্বামীকে বলেছিলেন, “আল্লাহ্’র পথে যুদ্ধে বের না হওয়া পর্যন্ত আমার বিছানা স্পর্শ করো না।”
উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) যারা যুদ্ধে পিছপা হতেন তাদের শাস্তি দিতেন এবং মহিলাদের তাদের স্বামীদের যু্দ্ধে যেতে উৎসাহিত করতে বলতেন। প্রকৃতপক্ষে, কিছু মহিলা তাদের স্বামীদের বলতেন, “যদি তুমি জিহাদের জন্য বের না হও, তাহলে তোমাকে তালাক দিতে হবে!” বর্ণিত আছে যে উম্মে হাকিম বিনতে আল-হারিস তার স্বামী ইকরিমা ইবনে আবি জাহলকে, যিনি ইসলামের তীব্র বিরোধিতা করার পর ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি ঘনিষ্ঠতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যতক্ষণ না তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, এবং তাই তিনি যুদ্ধে যোগ দেন এবং ইয়ারমুকে শহীদ হন।
মুসলিমদের সেনাবাহিনীতে সৈন্য এবং অফিসারদের অবহেলার পরিণতি হয় ভয়াবহ। কারণ, তারাই ক্ষমতা ও শক্তির অধিকারী, এবং তারাই নির্যাতিতদের সমর্থন করবে এবং মুসলিমদের সম্মান রক্ষা করবে বলে আশা করা হয়। তারা সাধারণ মানুষের মতো নয়। তাদের ব্যর্থতা তাদের পুরুষত্ব এবং মর্যাদা কেড়ে নেয়। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) জি/হা/দ থেকে পিছিয়ে থাকাদের প্রকাশ্যে লজ্জিত করতেন এবং বলতেন, “যে ব্যক্তি বৈধ শরিয়াহ ওজর ছাড়া জি/হা/দ ত্যাগ করবে তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না।”
এবং আমরা আপনাদের বলছি না, “অনেক দেরি হওয়ার আগেই আপনাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করুন”, কারণ প্রকৃতপক্ষে, ইতিমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে! বরং আমরা অপেক্ষা করছি, যাতে আপনারা আপনাদের অবহেলার জন্য, আপনাদের ব্যর্থতা এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্বের জন্য আল্লাহ্’র নিকট তওবা করুন। আপনাদের সেই ভাইদের সমর্থন করুন যারা হিযবুত তাহরীরের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র তথা খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে, যা আল্লাহ্ নাযিলকৃত বিধান অনুসারে শাসন করবে, মুসলিম ভূমি মুক্ত করার জন্য সেনাবাহিনীকে একত্রিত করবে, এবং ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, মিয়ানমারের নির্যাতিত মুসলিমদের সাহায্য করবে। উম্মাহ্ বিশ্বাসঘাতক, কাপুরুষ শাসক ও কমান্ডারদের উপর আশা হারিয়ে ফেলেছে, এবং এখন আপনাদের মধ্যে কেবল নিষ্ঠাবানরাই অবশিষ্ট আশার আলো।
তাহলে, আপনারা কি ডঃ আলা আল-নাজ্জার এবং এই উম্মাহ্’র অন্যান্য সম্ভ্রান্ত নারীদের ডাকে সাড়া দেবেন? আপনারা কি সালাহউদ্দিন, মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং খালিদ ইবনে আল-ওয়ালিদের সাথে মর্যাদার কাতারে যোগ দেবেন? নাকি আপনারা জাহান্নামে ফেরাউন ও হামানের মত ক্ষতিকারক শাসক এবং তাদের সামরিক কমান্ডারদের সাথে দাঁড়াতে সন্তুষ্ট থাকবেন?
এই দিনগুলো বিচারবুদ্ধি এবং হৃদয়ে বিন্দুমাত্র ঈমান থাকা প্রত্যেকের জন্য পরীক্ষার দিন, তারা আসলে কী পাওয়ার যোগ্য তা বেছে নেওয়ার জন্য। জেনে রাখুন যে চূড়ান্ত সাফল্য সত্য ও ন্যায়নিষ্টদের জন্য। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, “তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে ও সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি হচ্ছে আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে” [সূরা আলি ইমরান : ১৩৩]। (www.hizb-ut-tahrir.info/en হতে সংকলিত)।
[নিউজ: “ঈদের দিনে ৪২ ফিলিস্তিনী মুসলিমকে হত্যা করল ইসরাইল” (লিঙ্ক:https://www.jugantor.com/international/963144)
