বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং দক্ষ বিচার বিভাগ গড়ে তোলাই মূল লক্ষ্য: প্রধান বিচারপতি




খবরঃ

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ ইউএনডিপি’র ‘রুল অব ল সম্মেলনে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের জন্য তার ঘোষিত রোডম্যাপের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আমাদের সংস্কার রোডম্যাপের মূল লক্ষ্য বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা এবং দক্ষ বিচার বিভাগ গড়ে তোলা। মঙ্গলবার রাতে ইউএনডিপি’র বার্ষিক ‘রুল অব ল’ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে দেয়া বক্তৃতায় বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সংস্কার রোডম্যাপের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, সাংবিধানিকতা বৈধতা এবং মানবাধিকারের অভিভাবক হিসেবে অন্যান্য সব সংস্কার প্রচেষ্টার সম্মতি প্রদানকারী বিচার বিভাগকে অবশ্যই প্রথমে স্বৈরাচারী কব্জা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে এবং আমাদের আদালতের সামনে ন্যায়বিচার প্রার্থীদের জন্য কার্যকর প্রতিকার প্রদানকারী একটি স্বাধীন এবং বিশ্বস্ত বিচারক হিসেবে নিজেকে রূপান্তরিত করতে হবে। (https://dailynayadiganta.com/bangladesh/law-and-justice/23F92wceJQVz)

মন্তব্যঃ

১৯৭২ সালের পর থেকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগে বহু সংস্কার করে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা কখনো রাষ্ট্রপতির হাতে কিংবা আবার কখনো সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে, বিচারপতি নিয়োগ ও অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান কার্যকর করা কিংবা বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু, আমাদের বিচার বিভাগ সর্বদাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অধীন এবং ক্ষমতাসীন সরকার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের বিচার বিভাগে হওয়া বিভিন্ন সংস্কার রাষ্ট্রের ৩ টি বিভাগের (আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ) মধ্যে প্রকৃত ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। প্রথমত, বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কিংবা সংসদের হাতে তুলে দেওয়ার মানে হচ্ছে বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হওয়া। ফলশ্রুতিতে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, যখন আওয়ামী বা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসে, তখন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সকল দুর্নীতির অভিযোগ সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল করা হয় এবং সকল বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের শাস্তি ও হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দেয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার কারণে। এমনকি রাজনৈতিক চাপে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা পদত্যাগ ও দেশত্যাগে বাধ্য হন! দ্বিতীয়ত, বিচারক নিয়োগ ও অপসারণের বিধান বর্তমানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরলেও এই কাউন্সিলের সদস্যদের নিয়োগ প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বের বাইরে নয়। যেমনঃ এই কাউন্সিলের প্রধান হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি যিনি রাষ্ট্রপতি দ্বারা নির্বাচিত, আর কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য এটর্নী জেনারেলও সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত। তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হলেও তা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব মুক্ত নয়। এমনকি, অভূতপূর্ব গণআন্দোলন পরবর্তী ও নির্দলীয় এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসও নিজের ও তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর মওকুফ করা সহ বিভিন্ন বিচারাধীন মামলাগুলো থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। সম্ভাব্য ভবিষ্যত সরকারী দল বিবেচনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ অনেক হেভিওয়েট নেতাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, পতিত হাসিনার অধীনে নির্বাচনকে অবৈধ বলা হলেও উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে বিএনপি নেতা ইশরাককে ডিএনসিসির মেয়র পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে! আবার সরকার বিদেশীদের স্বার্থে পিলখানা হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার স্থগিত রেখেছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের মত কালো আইন বহাল রেখেছে। 

মূলত, পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল সমস্যা হচ্ছে, নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেস্টাগণ সর্বদাই সার্বভৌম ক্ষমতা অধিকারী এবং আইনের ঊর্ধ্বে থাকে। একটি দল যখন আইনসভা ও নির্বাহী উভয়েরই ভূমিকা পালন করে। নির্বাহী বিভাগের (সরকারপ্রশাসন) সদস্যরা আইন বিভাগের সদস্যদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হয়। অন্যদিকে বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা নির্বাহী বিভাগ(সরকার) কর্তৃক নিযুক্ত হন! এছাড়া । তাহলে, আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ একই ধরণের ব্যক্তি হলে এবং বিচার বিভাগের সদস্যরা তাদের দ্বারাই নিযুক্ত হলে আইন বিভাগ, নির্বাহী এবং বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন(Separation of Power) কীভাবে হবে? বিচার বিভাগ কিভাবে রাষ্ট্রের অন্য বিভাগের অধীনস্ততা থেকে মুক্ত বা স্বাধীন হবে? সুতরাং, ক্ষমতা পৃথকীকরণের(Separation of Power) তত্ত্বটি কেবল পশ্চিমা দর্শনের পুরানো বইগুলোতেই শোভা পায়, পৃথিবীর কোনও পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটার কোন অস্তিত্ব নেই। তাই এই ব্যবস্থায় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার ধারণা একটা মিথ (Myth)। 

অন্যদিকে, ইসলামী ব্যবস্থায় আল্লাহ্‌ ব্যতিত অন্যকোন আইন প্রণেতা নেই। ফলে রাষ্ট্রের সব বিভাগ এক সার্বভৌম সত্তা আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র আইন অনুযায়ী আবদ্ধ। খলিফা নির্বাহী প্রধান হলেও তিনি যখনই মাত্র শারীআহ্‌ আইন ভঙ্গ করবেন সাথে সাথে তাকে মাহ্‌কামাতুল মাযালীম আদালতের মুখোমুখি ও অপসারিত হতে হবে। প্রধান বিচারক খলিফা দ্বারা নির্বাচিত হলেও, খলিফা বা নির্বাহী বিভাগের কারো বিরুদ্ধে বিচার চলাকালীন বিচারককে অপসারণ করা যাবেনা। তাছাড়া, বিচারকের শারী‘আহ্‌ আইনের ভিত্তিতে বিচারকার্য করতে হবে, এখানে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি কিংবা নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নেই, অন্যথায় তিনি সাথে সাথে অযোগ্য ঘোষিত হয়ে অপসারিত হবেন। তাই, বিচারকরা স্বাধীনভাবে কেবলমাত্র আইন এবং মামলার উপর ভিত্তি করেই বিচারের ফলাফল নির্ধারণ করতে সক্ষম হবেন; মিডিয়া, রাজনীতি বা অন্যান্য বিষয় তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারবে না। খিলাফতে অপরাধের জন্য সাধারণ 'ক্ষমা'র কোন ধারণা নেই, যেমনটি পশ্চিমা বিশ্ব এবং তাদের দালাল দেশগুলোতে বিদ্যমান। শারী‘আহ্‌ স্পষ্টভাবে বলে যে, একজন বিচারককে অবশ্যই একটি মামলায় ন্যায়পরায়ণ, জ্ঞানী এবং নিরপেক্ষ রায় দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) বলেছেন: “বিচারক তিন ধরণের, যাদের মধ্যে একজন জান্নাতে এবং দুজন জাহান্নামে যাবে। যে ব্যক্তি জান্নাতে যাবে সে হলো সেই ব্যক্তি যে সঠিক কী তা জানে এবং সেই অনুযায়ী রায় দেয়; কিন্তু যে ব্যক্তি সঠিক কী তা জানে এবং তার রায়ে অত্যাচার করে সে জাহান্নামে যাবে; এবং যে ব্যক্তি অজ্ঞ থাকা অবস্থায় মানুষের পক্ষে রায় দেয় সে জাহান্নামে যাবে” [সুনান আবু-দাউদ]। উমর(রাঃ)-এর শাসনামলে মিশরের গভর্ণর আমর বিন আল আস (রাঃ)-এর ছেলে এক অমুসলিম নাগরিকের ছেলেকে মারধর করার মামলায় বিচারক গভর্নর আমর বিন আল আস এবং তার ছেলে উভয়কেই বেত্রাঘাতের শাস্তির রায় দেন, এক ইহুদী কর্তৃক বর্ম চুরির মামলায় খলীফা আলী (রা)-এর বিরুদ্ধে রায় দেয়া হয়। আর খিলাফত ব্যবস্থার অধীনে বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার মূল কারণ ছিল মানুষের তৈরি যেকোন ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা (যেমন গণতন্ত্র) থেকে এর বিচ্ছিন্নতা। আসন্ন খিলাফত রাষ্ট্র সাহসী ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে আবারো প্রকৃত ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনবে বি-ইযনিল্লাহ। 

  -    কাজী তাহসিন রশীদ


Previous Post Next Post