খবরঃ
মোহাম্মদ আফরিজি বিন আপন নামের ২৬ বছর বয়সী এক তরুণ জাপানে গিয়েছিলেন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। তাকে ফিরতে হলো কফিনবন্দি হয়ে সাদা কাফনের চাদর গায়ে জড়িয়ে। জাপানের মতো উন্নত প্রযুক্তির দেশে এক বাংলাদেশি তরুণ দিনের পর দিন না খেয়ে, এমনকি পানির অভাবেও কেটেছে নিঃসঙ্গ সময়। সে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, মৃত্যুকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন বেঁচে থাকার চেয়ে সহজ উপায় হিসেবে। পরিবার ও ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, আফরিজিএর সমস্যার সূত্রপাত ঘটে কলেজের বকেয়া টিউশন ফি নিয়ে। আর্থিক অনটনের কারণে একে একে বন্ধ হয়ে যায় তার প্রায় সব মৌলিক সেবা—বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, এমনকি মোবাইল সংযোগও। দিন শেষে, তিনি হয়ে পড়েন কার্যত ঘরবন্দি। জাপানের একটি ব্যস্ত শহরের ছোট্ট একটি ভাড়া বাসায় নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছিলেন আফরিজি। (kalerkantho.com/online/nrb/2025/07/01/1540224)
মন্তব্যঃ
জাপানের মত উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে একজন অভিবাসী ছাত্রের অভুক্ত থেকে মৃত্যুর ঘটনা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর অন্তর্নিহিত দুর্বলতা আবারও আমাদের সামনে নিয়ে আসলো। উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে জাপানের সমাজ শুধুমাত্র অতিমাত্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয় বরং রাষ্ট্রীয় কাঠামো আন্তকেন্দ্রীকতাকে আইনের মাধ্যমে রক্ষা করে। উদাহরণস্বরূপ, অভুক্ত আপন যখন না খেয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিল তা জেনেও তার প্রতিবেশী বা বন্ধুরা তাকে সাহায্য করতে পারে নাই, কারণ কোন ব্যক্তি মৃত্যু পথযাত্রী হলেও জাপানের আইনে প্রশাসন ছাড়া অন্য কারো দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এছাড়াও, জাপানে বিদ্যুৎসহ বেশীর ভাগ জরুরী সেবা বেসরকারীভাবে পরিচালিত হয়। এই সকল বেসরকারী কোম্পানীগুলো এতটাই মুনাফামুখী যে তারা মাত্র কয়েক সপ্তাহের বিল বকেয়া থাকলেই বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই ক্ষেত্রে তারা পরিবেশ যেমনঃ তীব্র তাপদাহ, গ্রাহকের পরিস্থিতি যেমনঃ অতিবৃদ্ধ বা কোন কারণে সাময়িক সময়ের জন্য আয়ের ব্যত্যয় বিবেচনা করে না। বিদ্যুৎ কোম্পানীগুলোর এরকম অতিমুনাফালোভী আচরণের কারণে প্রায়ই গ্রাহকদের মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে বৈরী আবহাওয়ার সময় এবং বার্ধক্যে উপনীত নাগরিকদের ক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করার ব্যর্থতার কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং পরবর্তীতে তীব্র তাপদাহ হিটস্টোকে বিভৎস মৃত্যু জাপানের সাধারণ ঘটনা। (বিস্তারিত জানতে পড়ুনঃ mainichi.jp/english/articles/20180801/p2a/00m/0na/023000c)।
পুঁজিবাদী সমাজ ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মুনাফা অর্জনকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে এমন একটা সমাজ তৈরি করেছে যেখানে কোন কারণে আর্থিক সংগতি হারানো একজন ব্যক্তির জন্য অভুক্ত বা জরুরী সেবা না পেয়ে মৃত্যু ছাড়া আর কোন বিকল্প থাকে না। পুঁজিবাদ যেখানেই পরিপূর্ণ কাঠামোসহ বাস্তবায়িত হয়েছে সেখানেই এরকম অসংখ্য মানবিক এবং সামাজিক সংকট তৈরি করেছে। এমনকি, পুঁজিবাদের বৈশ্বিক নেতৃত্বদানকারী আমেরিকাও অসংখ্য সংকটে ডুবে আছে। বিখ্যাত নিউজ আউটলেট দ্যা গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় আমেরিকাতে প্রতি বছর ৪৫, ০০০ ব্যাক্তি স্বাস্থ্য বীমা না থাকার কারণে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করে। (বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ The Americans dying because they can't afford medical care, the Guardian, জানুয়ারী ৭, ২০২০)। অর্থাৎ, সীমাবদ্ধ মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা জনগণকে দূর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে নাই। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর পশ্চিমা উপনিবেশবাদী শক্তি এবং তাদের চিহ্নিত দালালরা সংস্কারের নামে আমাদের উপর পশ্চিমাদের ভ্রান্ত সেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাঠামোকে আরও শক্তভাবে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। তারা কি ভুলে গেছে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, “আর যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ থাকবে, নিশ্চয়ই তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন জমায়েত করব অন্ধ অবস্থায়” (সূরা ত্ব-হা, আয়াত ১২৪)। ইসলামে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদাসমূহ নিশ্চিত করাকে রাষ্ট্রের জন্য দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছে। রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে এই দায়িত্ব পালনের ভার খলিফার উপর অর্পণ করা হয়েছে। খিলাফতের ১৩০০ বছরের ইতিহাসে দেখা দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই। মুসলিম শাসকরা শুধুমাত্র নাগরিকদের প্রয়োজন পূরণকে গুরুত্ব দিতেন না বরং তারা মুসলিমদের ভূখন্ডে সাময়িক সময়ের জন্য আগত মুসাফিরদের জন্য অসংখ্য সরাইখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যাতে সম্বলহীন মুসাফীর ব্যাক্তিরা বিনামূল্যে থাকা-খাওয়াসহ বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে পারতেন। ইসলামী শাসন এতটাই বরকতময় ছিল যে বনের পশু-পাখি পর্যন্ত এর সুবিধা ভোগ করতো। খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আজিজ এর সময় বায়তুল মালের এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যে তা থেকে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের প্রয়োজন মিটানোর পরেও উদ্বৃত্ত ছিল। তখন খলিফা উদ্বৃত্ত সম্পদ ব্যায় করে গম কিনে পাহাড়ের উপরে ছিটিয়ে দিতে বলেন যেন মুসলিমদের ভূমির কোনো পাখিও অভুক্ত না থাকে। এই সবই সম্ভব হয়েছিল বরকময় খিলাফত রাষ্ট্র বাস্তবায়নের ফলে। “আর যদি সেসব জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তবে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আসমান ও যমীনের বরকতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম” (আল-আ'রাফ, আয়াত ৯৬)
- সিরাজুল ইসলাম