মাইলস্টোন ট্রাজেডি: বিধ্বস্ত বিমান, অচেতন দায়িত্ববোধ

 


খবরঃ

ক্লাস সবে শেষ হয়েছে। বন্ধুবান্ধবীদের কেউ কেউ বেরিয়ে গেছে। কেউ হয়তো মা-বাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। কেউ কেউ নিশ্চয়ই ছিল গল্প আর আড্ডায় মেতে। হুট করে আকাশ থেকে যেন আগুন নামল। ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল একটি যুদ্ধবিমান। স্কুলটাই যেন পরিণত হলো এক অজানা যুদ্ধক্ষেত্রে—যেখানে কেউ কারোর শত্রু ছিল না। প্রাণ গেল শিশুদের, যারা ঘরে ফেরার জন্য ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিল। কেউ মারা গেছে ঘটনাস্থলেই। কেউ কেউ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে এখন। আশা করতে চাই, তাদের সবাই বেঁচে উঠবে। তাদের যারা বেঁচে থাকবে, তাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই আতঙ্ক নিয়ে কাটাবে বাকি জীবনটা। শুধু কী আক্রান্ত ওই শিশুগুলোই এমন আতঙ্কঘোরে থাকবে? আসলে আতঙ্ক আজীবনের হয়ে থাকতে পারে, মাইলস্টোনের যে অংশটি দুর্ঘটনায় পড়েনি, সেখানে দুর্ঘটনার সময় অবস্থান করা শিশুরাও। (https://bangla.bdnews24.com/opinion/59cd45f650ee)

মন্তব্যঃ

মাইলস্টোন ট্রাজেডিতে পুরো জাতি যখন শোকে স্তব্ধ, তখন আমরা লাশের সংখ্যা গোপন করা নিয়ে সরকার কর্তৃক পুরোনো খেলার পুনরাবৃত্তি দেখলাম; এবং দেখলাম এর প্রতিবাদ করায় ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের উপর পুলিশের হামলা। আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, চারটি রাজনৈতিক দলের সাথে হাস্যোজ্জ্বল প্রধান উপদেষ্টার দ্রুত বৈঠক এবং সেখানে কতিপয় রাজনৈতিক নেতার পক্ষ থেকে পরিস্থিতি (বিক্ষুব্ধ জনগণ) নিয়ন্ত্রণে কঠোর হওয়ার আহ্বান। সবাই যখন প্রচন্ড শোকে আচ্ছন্ন, তখন বাংলাদেশ পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের আনন্দ আয়োজন বন্ধ হয়নি; বন্ধ হয়নি জাতীয় ঐক্যমত কমিশনে ক্ষমতালোভীদের ক্ষমতার ভাগাভাগির বৈঠক; বন্ধ হয়নি এনসিপি’র নির্বাচনী প্রচারণার দেশ সফর।

কিন্তু, দেশের সাধারণ জনগণ তাদের দায়িত্ব পালনে এতটুকু কার্পণ্য করেনি। দেখা গেছে, উদ্ধারকাজে ও আহতদের রক্তদানে তাদের অভাবনীয় অংশগ্রহণ; অন্তঃত ২০জন শিক্ষার্থীকে বাঁচিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়া শিক্ষিকার বীরোচিত আত্মত্যাগ। অন্যদিকে, প্রত্যক্ষ করলাম, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে উদ্ধারকাজে বরাবরের মতো সরকারের ব্যর্থতা; হাসপাতালগুলোয় বার্ণ ইউনিট না থাকায় আহত শিশুদের যন্ত্রণা। নেতাকর্মীর বহর নিয়ে উদ্ধারকাজে বিঘ্ন ঘটানো রাজনৈতিক নেতাদের তথাকথিত মায়াকান্না জনগণকে ক্ষুব্ধ করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে ত্রাণ তহবিলের আহ্বান করে নিহত আহতদের সাথে তামাশা করা হলো, ঠিক যেমন হাসিনা করোনা কালীন সময়ে ধনী ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিল। এমন যেন, রাষ্ট্রের সবকিছুর জন্য তহবিল আছে কিন্তু জনগণের জন্য নাই! সরকারী টাকায় তরুণ তুর্কিদের সফর ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, অথচ জনগণের জন্য তহবিল জোগাড়ের দরকার হয়!

এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেই লক্ষ্যে মূল কারণ চিহ্নিত না করে, শুধু নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি গঠন এবং শোক ঘোষণা জাতির সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। সবাই জানে যে, মূল কারণগুলো হলো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ব্যাপক দুর্নীতি এবং জনগণের দেখভালের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীর দায়িত্বহীনতা এবং অবহেলা। নিহত শিক্ষার্থীর এক শোকাতুর বাবা ক্ষোভে বলছিলেন, আমরা এদেশে থাকবো না, এদেশের পটিশিয়ানরা দেশটাকে দুষিত করে ফেলেছে। এই যুদ্ধ বিমানের দুর্ঘটনা ও তৌকিরের মত একাধিক বীর সেনার মৃত্যুর বাংলাদেশে এটাই প্রথম নয়, গত একদশকে এই F-7 একাধিকবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। রাশিয়ার Mig-21 এর আদলে গড়া চীনের তৈরি এই F-7 বলা হয়, গ্র্যান্ডপা (দাদার আমল) ফাইটার জেট, যা চীন ১৯৬০-এর দশকে তৈরি করেছিল ও ২০১৩ সালে এর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। অভিযোগ উঠেছে, জনগণের কষ্টার্জিত করের টাকা দিয়ে কেন এমন বিমান কেনা হলো? কেন এখনো বিমানবাহিনীর সরঞ্জামের আধুনিকায়ন হয়নি। কেন বিমান বন্দরের রানওয়ের পাশে এত গণবসতিপূর্ণ এলাকা গড়ে উঠলো, কেন গণবসতিপূর্ণ লোকালয়ের উপর দিয়ে প্রশিক্ষণ বিমান চালানো হয়। কেন রাজউক রানওয়ের এত সন্নিকটে স্কুল ও কলেজ নির্মাণের অনুমতি দিল? নতুন বাংলাদেশ তৈরির দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকার ও ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতারা, তথাকথিত ক্ষমতার ভাগাভাগির ও পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থাকে ভিন্ন মোড়কে চাপিয়ে দেয়ার সংস্কারের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু জনগণের অতিপ্রয়োজনীয় দুর্নীতি গ্রস্ত স্বাস্থ্যখাত, নিরাপত্তা সরঞ্জাম, শিক্ষাখাত, সামরিকখাত, কর্মসংস্থান, ইত্যাদি নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই।

বার বার ঘটে যাওয়া এই নির্মম ঘটনাগুলোর মূল কারণ ও উৎস- ধর্মনিরপেক্ষ শাসকগোষ্ঠী ও শাসনব্যবস্থাকে অক্ষত রেখে, ঘটনাগুলো থেকে প্রতিকার চাওয়া, কিংবা শোক ঘোষণা করা কখনোই সমাধান নিয়ে আসবে না। বরং আমাদেরকে এমন যত্নশীল শাসক ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা আল্লাহ্‌’র শারীআহ্‌ বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হবে এবং তাঁর বিধান অনুযায়ী মানুষের বিষয়াদী পরিচালনা করবে। এটি এমন একজন ন্যায়পরায়ণ খলিফাকে বাইয়াত দেওয়ার মধ্যে নিহিত রয়েছে যিনি সমস্ত ধরণের দুর্নীতিকে দৃঢ়ভাবে আঘাত করবেন, তাদের উত্সগুলোকে নিশ্চিহ্ন করবেন এবং তাদের শিকড় কেটে ফেলবেন - তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌’র সন্তুষ্টি। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেনঃ "তোমরা প্রত্যেকেই একেকজন মেষপালক এবং তোমাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ মেষপালের দায়িত্বশীল। জনগণের উপর শাসক একজন রাখাল এবং তার প্রজাদের প্রতি দায়িত্বশীল..." (বুখারী ও মুসলিম)। মুমিনদের মা আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) বলতে শুনেছিঃ "হে আল্লাহ্‌, যে ব্যক্তি আমার উম্মতের বিষয়াদির ভারভার গ্রহণ করে এবং তাদের প্রতি কঠোরতা অবলম্বন করে, তার প্রতি কঠোর হও; আর যে ব্যক্তি আমার উম্মতের বিষয়াদির ভার গ্রহণ করে এবং তাদের প্রতি সদয় হয়, তার প্রতি সদয় হও [মুসলিম]।

    -    ফাহিম আব্দুল্লাহ্‌


Previous Post Next Post