কঠোর মুদ্রানীতি বজায় রাখার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন মুদ্রা ছাপিয়ে আর্থিকভাবে দুর্বল ১২টি ব্যাংককে সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার সহায়তা দিয়েছে। গত ৫ আগস্টের পর থেকে ধাপে ধাপে এই টাকা সরবরাহ করা হয়েছে। আজ শনিবার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, এই উল্লেখযোগ্য আর্থিক সহায়তা ব্যাংকিং খাতকে স্থিতিশীল করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা একীভূত করার পরিকল্পনা করছে সরকার (https://www.kalerkantho.com/online/business/2025/06/28/1538746)।
মন্তব্যঃ
দুর্বল ১২ ব্যাংককে এই সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার সহায়তা প্রকৃতপক্ষে ধনিক শ্রেণীর দুর্নীতি ও লুটপাটকে “পুরস্কৃত” করার পুঁজিবাদী আয়োজন। এই সহায়তা মূলত “ফিয়াট মানি” বা কাগজের ভিত্তিহীন মুদ্রা ছাপিয়ে করা হয়েছে, যার বোঝা জনগণকে বইতে হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই পদক্ষেপ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার “Corporate Bailout” নীতির সাথে সম্পর্কিত, যেখানে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাধারণ জনগণের অর্থে বাঁচিয়ে রাখা হয় পুঁজিপতিদের স্বার্থে। এতে পুঁজিপতি শ্রেণী লাভবান হয়, আর দরিদ্র জনগণ ঋণের বোঝা বহন করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে হাসিনার শাসনামলে ব্যাপক লুটপাটের ফলে। বেসিক ব্যাংকে ৪,৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দুদকের তদন্ত থাকলেও মূল হোতাদের কেউই শাস্তি পায়নি। সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়, এবং জনতা ব্যাংকে আবদুল কাদের মোল্লা ট্রাস্টের নামে ১ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারিও বহু আলোচিত। এই দুর্নীতিগুলো ছিল সরাসরি সরকার দলীয় রাজনীতিবিদ ও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জড়িত। এখন এই ব্যাংকগুলোর লুটপাটের দায় জনগণের ঘাড়ে চাপাতে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে মূল্যস্ফীতির ঢেউ তুলছে। ২০২৪ সালের শেষে মূল্যস্ফীতি পৌঁছে ৯.৭ শতাংশে, যার ফলে পেঁয়াজ, চাল, ডাল, তেল, ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আয় ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে রিজার্ভ কমেছে, বৈদেশিক মুদ্রা সংকট বেড়েছে যার মূল কারণ এই অদূরদর্শী বেইলআউট নীতি। অথচ এই দুর্নীতিবাজদের কোনো জবাবদিহিতা নেই, কারণ তারা রাজনৈতিক ও কর্পোরেট ক্ষমতার বলয়ে। ব্যাংকলুটেরাদের দায় থেকে রক্ষা করে পতিত হাসিনার মত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও সেই একই নীতির পথে হাটছে। হাসিনার আমলে আমরা দেখেছি, দরিদ্ররা যখন ক্ষুদ্রঋণ নিতে যেতো, তখন নানা রকম শর্ত জুড়ে দেয়া হতো। কেউ ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তার ভিটেবাড়ি কেড়ে নেয়া হতো, কিন্তু পুঁজিপতিশ্রেণী বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীরা বিনা জামানতে হাজার কোটি টাকার লোন অনায়াসে পেয়ে যেতো, আর খেলাপি হলেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতো। এটাই পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য যেখানে ধনীদের জন্য থাকে সুযোগ, আর গরিবদের জন্য থাকে শোষণ। এই ব্যবস্থা মানুষের মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করে, সম্পদের প্রবাহকে ওপরের দিকে পুঞ্জিভূত করে।
এই বৈষম্যমূলক ও শোষণমূলক অবস্থার সমাধান ইসলামী অর্থব্যবস্থায় রয়েছে। ইসলামে দুর্নীতিপরায়ণদের রাষ্ট্রের অর্থে বাঁচানোর সুযোগ নেই। ইসলামী রাষ্ট্র তথা খিলাফত দুর্নীতিপরায়ণ প্রতিষ্ঠানের মালিকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে এবং দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতির অর্থ বাজেয়াপ্ত করবে। এর একটি বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে, খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) তাঁর শাসনামলে দুর্নীতিপরায়ণদের সম্পদ “মাল আল-গুলুল” (অবৈধভাবে আত্মসাৎকৃত সম্পদ) হিসেবে গণ্য করে তা বাজেয়াপ্ত করতেন। তিনি ইয়ারমুক যুদ্ধ শেষে কিছু প্রভাবশালী আমেল ও গভর্নরের সম্পদ সন্দেহজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার খবর পান। উমর (রাঃ) দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্ব প্রদানের সময় সম্পদ গণনা করে রাখতেন যাতে তার দায়িত্বের অবসরের সময় কত সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে তা বের করতে পারেন। তিনি (রা.) অতিরিক্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে বাইতুল মাল-এ জমা দিতেন এবং বলতেন, “তোমাদের ওপর আমি এমন কাউকে নিয়োজিত করব না যে তোমাদের সম্পদ নিজের সম্পদ মনে করে।” এই ঘটনাটি প্রমাণ করে, খিলাফত রাষ্ট্র দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে।
- মোঃ জাফর আহমেদ