খবরঃ
বাংলাদেশে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের জুলাই সনদের মৌলিক কয়েকটি বিষয়ে দলগুলোর মতপার্থক্যের মীমাংসা এখনো হয়নি। এর বাস্তবায়ন প্রশ্নেও বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থান বা প্রকাশ্যে নানা মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে।... জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়া না দেওয়ার প্রশ্নেই বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির মূল বিরোধ। বিএনপি এবং এর মিত্র কিছু দল ও জোট অবস্থান নিয়েছিল আইনি ভিত্তি দেওয়ার বিরুদ্ধে। ...বিষয়টাতে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের মতামত নিতে রেফারেন্স পাঠানো যায় কি না, এনিয়ে বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলোর মধ্যে আলোচনা রয়েছে। জুলাই সনদকে সংবিধানের উর্ধ্বে স্থান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এর চুড়ান্ত খসড়ায়। বলা হয়েছে, বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সে ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান, প্রস্তাব বা সুপারিশ প্রাধান্য পাবে। এ ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও এনসিপির মতপার্থক্য। দলটির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, জুলাই হচ্ছে রাজনৈতিক সমঝোতা দলিল। কোনো সমঝোতা দলিলকে 'সুপ্রা কনস্টিটিউশনাল বা সংবিধানের উর্ধ্বে অবস্থান দেওয়া যায় না। সেটা করা হলে খারাপ নজির তৈরি হবে। (https://www.bbc.com/bengali/articles/c627dp163vlo)
মন্তব্যঃ
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মতভেদ ও দ্বন্দ্ব কোনো নতুন বিষয় নয়। বর্তমানে জুলাই অভ্যুত্থানের পর যে “জুলাই সনদ”কে সামনে রেখে রাজনৈতিক ঐক্য আনার প্রচেষ্টা চলছে, সেটিও একই পুরোনো দৃশ্যপটের পুনরাবৃত্তি মাত্র। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বিমত করছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো—ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে এসব দলের মধ্যে কোনো মৌলিক মতভেদ নেই। তবুও ক্ষমতার ভাগাভাগি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের প্রশ্নে তারা আজও সমঝোতায় পৌঁছাতে পারছে না। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য সবসময় ছিল পরিস্থিতিনির্ভর ও অস্থায়ী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাময়িকভাবে একটি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু বিজয়ের পরপরই দল ও গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিভাজন শুরু হয়। একই চিত্র দেখা গেছে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানেও। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় “তিন জোট” ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ের পরপরই সেই ঐক্য ভেঙে যায় এবং শেষ পর্যন্ত “তিন জোটের রূপরেখা” ইতিহাসে বিস্মৃত হয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাহাত্তরের সংবিধান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি; বরং বিভক্তি বাড়িয়েছে।
আজকের জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতাও এর ব্যতিক্রম নয়। পুঁজিবাদী মতাদর্শ রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলোকে একটি কৃত্রিম ঐক্যে বেঁধে রাখার চেষ্টা করে, যা মূলত বিভিন্ন স্বার্থবাদী পক্ষের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা বা কম্প্রোমাইজ সলিউশন ছাড়া আর কিছু নয়। এই ঐক্য যতক্ষণ পর্যন্ত একটি সাধারণ শত্রু থাকে ততক্ষণ টিকে থাকে। শত্রুপক্ষের পতন বা দুর্বলতার পরই আবার দলগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও আজ সেই পুরোনো বাস্তবতা ফিরে এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলো অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার জন্য ঐক্যের সনদ বা নীতিমালা তৈরির চেষ্টা করছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কেবল সনদ, রূপরেখা বা সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত ঐক্য কোনোদিনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ হলো—জনগণের বিশ্বাস, আবেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণকারী সঠিক মতাদর্শের ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হলে সেটি টেকসই হয় না। যুদ্ধ কিংবা অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা ঐক্য সবসময় সাময়িক হয়, কারণ এর ভিত্তি থাকে একটি “কমন শত্রু”। শত্রু পরাজিত হলে ঐক্যও ভেঙে যায়। তাই বাংলাদেশের প্রকৃত ঐক্য আসবে কেবল তখনই, যখন তা এদেশের জনগণের বিশ্বাস ও আবেগ তথা ইসলামী বিশ্বাস ও আবেগকে ধারণকারী ইসলামী আইডিওলজি (মতাদর্শের) আলোকে নির্মিত হবে। অন্যথায়, জুলাই সনদসহ যেকোনো দলিল বা কাঠামো একইভাবে ব্যর্থ হবে, যেমন ব্যর্থ হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সংবিধান বা নব্বইয়ের দশকের তিন জোটের রূপরেখা।
- রাশিদ হাসান