খবরঃ
দেশে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি আগস্ট মাসের প্রথম ১০ দিনে দেশে অন্তত ১৩টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯ জন, আহত হয়েছেন আরও ১৩ জন।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএফএস) তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সারা দেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৭৮ জন। এর সঙ্গে আগস্ট মাসের প্রথম ১০ দিনের ঘটনা যুক্ত করলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৭। এই সময়ে আহত হয়েছেন ২৬৬ জন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত কমপক্ষে ১১১ জন মানুষ ‘মব’ (উচ্ছৃঙ্খল জনতা) সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন। (https://www.prothomalo.com/bangladesh/crime/4aiowowvxl)
মন্তব্যঃ
বিচারহীনতার সংস্কৃতি ৫ আগস্টের আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। কিন্তু চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের বর্বরোচিত ভূমিকায় সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশের বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্যতা নেই। “বিচারহীনতার সংস্কৃতি” এবং “পুলিশের অগ্রহণযোগ্যতা” এর সুযোগে তথাকথিত মব জাস্টিস চলছে। মব জাস্টিস হলো যখন সংগঠিত গোষ্ঠী নিজেই, বিচার ব্যবস্থা এড়িয়ে বিচার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। এই মব জাস্টিসের ভালো কিংবা খারাপ দিক বিবেচনার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এটা প্রকৃতপক্ষে একটি সিস্টেম্যাটিক ব্যর্থতার লক্ষণ।
কারণ সাধারণত মব জাস্টিস হয়, যখন বিচার ব্যবস্থা দ্রুততা এবং ন্যায়ের সাথে বিচার প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। এই সমস্যাটা আসলে কোনো isolated problem না বরং এটি বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফসল। এটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দিকে একটু লক্ষ্য করলে এর প্রকৃত রূপ উন্মোচন করা যায়।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিচার প্রক্রিয়া এত জটিল এবং দীর্ঘ যে একটি ঘটনার ন্যায়বিচার পেতে যে সময় লাগে, সেই সময় অপরাধীর শিকার ব্যক্তি বা তার পরিবার-পরিজন ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা ও স্পৃহা হারিয়ে ফেলে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে চুড়ান্ত সত্য বলতে কিছু নেই। সত্য অর্থ এবং ক্ষমতা দিয়ে বদলানো যায়। এর ফলে এখানে যারা রাজনীতিবিদ এবং পুঁজিপতি তারা তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে এবং বিচারকে পরিবর্তন করতে পারে। এর ফলে অপরাধীরা এই ক্ষমতা ধরে অভিজাত ব্যক্তিদের ছায়াতলে বসবাস করে যারা বিচারকে দীর্ঘায়িত করতে পারে অথবা অনানুষ্ঠানিক কিন্তু ব্যবস্থা গত impunity দিয়ে মুক্তি দিতে পারে। যার ফলে অপরাধীরা অপরাধ করেও খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াতে পারে। ফলে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিচার একটি পণ্যে পরিণত হয় যা ধনীদের কাছে বিক্রি করা হয় এবং দরিদ্রদের এর থেকে বঞ্চিত করা হয়। এছাড়াও বিচার হওয়ার পরও শাস্তি প্রদান এ গড়িমসি করাতো আছেই। এসব কারণগুলি মানুষের মধ্যে ব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করে এবং যার ফলে মানুষ নিজের হাতে বিষয়গুলো নিয়ে নেয়।
অন্যদিকে, খিলাফত ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার একটি divine obligation। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা কুর‘আন-এ বলেন “হে ঈমানদারগণ! তোমরা সকল ক্ষেত্রেই বিচার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় থাকো, আল্লাহ্’র জন্য সাক্ষী হও, এমনকি যদি তা তোমার নিজের, পিতামাতার বা আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়। ধনী-গরীবের মধ্যে পার্থক্য করো না, কারণ আল্লাহ্-ই তাদের উভয়ের প্রতি অধিক অধিকারী” (সূরা আন-নিসা: ১৩৫)
খিলাফত ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার কোনো রাজনৈতিক হাতিয়ার বা পণ্য নয়। বিচার ব্যবস্থা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র প্রদত্ত শারীআহ্ অনুসারে পরিচালিত হয়, যা কোনো শাসক বা ক্ষমতা ধারণকারী ব্যক্তির প্রভাব মুক্তভাবে, শাসক ও প্রজার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে এবং এর দণ্ড ব্যবস্থা দ্রুত, প্রকাশ্য এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়। খিলাফত-এর ইতিহাস পর্যালোচনায় এর বাস্তব প্রমাণ দেখা যায়। যেমন: একবার উমর (রাঃ) তাঁর নিজের ছেলেকে মদ্যপানের অপরাধে শাস্তি দেন। খলিফা হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনো পক্ষপাতিত্ব করেননি। তাঁর ছেলে শরীয়তের নির্ধারিত শাস্তি অনুযায়ী বেত্রাঘাতের দণ্ডে দণ্ডিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত সেই আঘাতেই মারা যায়। উমর (রাঃ) ধৈর্যের সাথে এটি মেনে নেন এবং বলেন: ‘এটি আল্লাহ্’র হুকুম, আর আল্লাহ্’র আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়’।
আবার খিলাফতের সময় আলী (রাঃ) এক ইহুদির সঙ্গে আদালতে একটি মামলায় হেরে যান। বিরোধ ছিল একটি বর্ম (ঢাল) নিয়ে। বিচারক আলী (রাঃ)-এর কাছে প্রমাণ চাইলে তিনি কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। ইহুদি শপথ করে বলল যে সেটি তার, ফলে বিচারক ইহুদির পক্ষেই রায় দেন। পরে, এমন ন্যায়বিচার দেখে ইহুদি বিস্মিত হয়ে স্বীকার করল যে বর্মটি আসলে আলী (রাঃ)-এর, এবং সে ইসলাম গ্রহণ করল।" এটি বিচার বিভাগের ইতিহাসের এক দূর্লব ঘটনা যেখানে ক্ষমতার আসনে বসা শাসকের বিরুদ্ধে রায় গিয়েছে। যা প্রকৃতপক্ষে ইসলামের শাসন ও বিচার ব্যবস্থার সৌন্দর্য তুলে ধরে।
- আবির আব্দুল্লাহ্