খবরঃ
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে আসায় ব্যবসায়িক কার্যক্রমে গতি আনতে দেশের বড় করপোরেট ঋণখেলাপিসহ প্রায় ২৫০টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পরিশোধের জন্য আরও পাঁচ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত সময় দেবে। এর জন্য ন্যূনতম এক শতাংশ ডাউন পেমেন্ট এবং সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত গ্রেস পিরিয়ড দেওয়া হতে পারে বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন এ বিষয়ে অবগত কর্মকর্তারাএই সুবিধা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় রয়েছে আব্দুল মোনেম গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ ও তানাকা গ্রুপের মতো শিল্পগোষ্ঠী—একাধিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে যাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ শত শত কোটি টাকা। (https://bangla.thedailystar.net/economy/bank/news-692116)
মন্তব্যঃ
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জনগণের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল দেশে ধনী-গরীবের বৈষম্য দূর হওয়া সহ নিজেদেরকে যাবতীয় অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে মুক্ত করার মাধ্যমে একটা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা। কিন্তু শাসক পরিবর্তন হলেও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের চেহারা ও অর্থনৈতিক পলিসির কোন পরিবর্তন হয়নি। যার ফলে অন্তর্বর্তী সরকারও পতিত হাসিনা সরকারের মত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কতিপয় বৃহৎ ঋণখেলাপীদেরকে বেইল আউট এবং ঋণ পুনঃতফসিল করার অনুমতি দিয়ে জনগণের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জিত বিপুল অর্থ ক্ষুদ্র পুঁজিপতিগোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়ার পুঁজিবাদী পলিসি অক্ষুণ্ণ রেখেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্পদ সৃষ্টি ও বৃদ্ধিকেই মূল অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে দেখে। পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত নীতি-“ধনীদেরকে মোটাতাজা করলে তা চুইয়ে সাধারণ জনগণের কাছে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ "নিঃশেষিত" করবে অর্থাৎ ট্রিকেল ডাউন ইকোনমিক্স”কে অর্থনৈতিক সমস্যার জাদুকরী সমাধান হিসেবে ধরা হয়। তাই পুঁজিবাদী সরকারগুলো ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজিগুলোকে একত্রিত করে পুঁজিপতিদেরকে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে হৃষ্টপুষ্ট করে। এসব পুঁজিপতিগোষ্ঠী ঋণ পরিশোধ না করে পার পাওয়ায় তারা এই অর্থগুলো আত্মসাৎ করে। এরপর ট্রিকেল ডাউন তত্ত্ব অনুযায়ী এই লুটেরাগোষ্ঠীকে নতুন স্কিমের মাধ্যমে আবারও ঋণ নবায়ন করার সুযোগ দেওয়া হয়। এভাবে এই চক্রটি চলতেই থাকে। কিন্তু সম্পদ বন্টনের কোন পদক্ষেপ না থাকায় বাস্তবে সাধারণ জনগণ ও গরীবের উপর কোন কিছুই চুইয়ে পড়ে না, বিধায় প্রবৃদ্ধি শুধুমাত্র একটা ক্ষুদ্রগোষ্ঠীকেই সমৃদ্ধ ও মোটাতাজা করে। ফলশ্রুতিতে একদিকে ব্যাপক জনগোষ্ঠী সুবিধাবঞ্চিত ও চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যে পিষ্ট হচ্ছে এবং অন্যদিকে একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠী বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হচ্ছে। ২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশের ৪ কোটি জনগোষ্ঠী বহুমাত্রিক দারিদ্রের শিকার, কিন্তু অন্যদিকে একই সময়ে বর্তমানে বাংলাদেশের মোট সম্পদের ৫৮.৫% মাত্র ১০% লোকের হাতে কুক্ষিগত!!
নজিরবিহীন এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণ ও জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ইসলামের রয়েছে পুরোপুরি একটি ভিন্ন অর্থনৈতিক মডেল। আর নবুয়তের আদলে খিলাফত ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই এই অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা সম্ভব। ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পদ সৃষ্টি, ন্যায়সঙ্গত বন্টন ও প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে (বর্তমান ত্রুটিযুক্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে) সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রবর্তন করবে। কেবল সম্পদ সৃষ্টির উপর মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে, খিলাফত রাষ্ট্র সম্পদের সঠিক বন্টনের উপর জোর দেবে যাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সমস্ত মৌলিক চাহিদা পুরণের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। সুদভিত্তিক ঋণ ইসলামি শারীয়াহতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সুতরাং, সুদভিত্তিক ঋণ নির্ভর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মত কোন লুটপাটের মেশিন ইসলামী রাষ্ট্রে থাকতে পারবে না। ইসলামের প্রকৃত অর্থনীতি প্রকৃত পণ্যদ্রব্যের উৎপাদনের উপর জোর দিয়ে সম্পদ সৃষ্টি করবে। এক্ষেত্রে ঋণভিত্তিক উৎপাদন সংস্কৃতিকে ন্যায়সঙ্গত মালিকানাভিত্তিক অংশগ্রহণের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করবে। সম্পদের মালিকানা বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর হওয়ার ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অর্থনীতির মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করবে। কারণ এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও পণ্যের চাহিদা উভয়ই বৃদ্ধি পায়। যার ফলে বিনিয়োগ ও পণ্য উৎপাদন উৎসাহিত হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুফল সমাজের সকল শ্রেণীর কাছে পৌঁছাবে এবং ধনী-গরীবের বৈষম্য দূর হবে। ব্যবসা কিংবা শিল্প কারখানা স্থাপন কিংবা কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে সাধারণ জনগণকে বায়তুল মাল হতে বিনাসুদে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। এ কারণে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মত ক্ষুদ্র পুঁজিপতিরা জনগণের অর্থ ঋণ হিসাবে গ্রহণ করে লুটপাটের কোন সুযোগ পাবে না। এছাড়া ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধনীদের সঞ্চয়ের উপর ২.৫% হারে যাকাত আরোপ করে সম্পদকে ধনীদের হাতে কুক্ষিগত না রেখে পুরো উম্মাহ্’র মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া নিশ্চিত করে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন: “যাতে ধন-সম্পদ তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তশালী কেবল তাদের মধ্যে পুঞ্জীভূত না হয়” (সূরা আল-হাশর: ৭)।
- কাজী তাহসিন রশীদ