খবরঃ
আয়কর রিটার্ন না দিলে আপনার গ্যাস-বিদ্যুৎসহ পরিষেবার সংযোগ কেটে দেওয়া হতে পারে। আয়কর আইনে সেই ক্ষমতা কর কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের যে আয়কর নির্দেশিকা প্রস্তুত করা হয়েছে, তাতে রিটার্ন জমা না দিলে পাঁচ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো পরিষেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কোনো করদাতা যদি রিটার্ন জমা না দেন, কিন্তু তাঁর করযোগ্য আয় আছে কিংবা রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা আছে; তাহলে কর কর্মকর্তারা চাইলে ওই ব্যক্তির বাসাবাড়ি কিংবা প্রতিষ্ঠানের গ্যাস-বিদ্যুৎসহ পরিষেবার লাইন কেটে দিতে পারেন। আয়কর নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে রিটার্ন দাখিল না করলে করদাতার যেসব বিষয়ের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেগুলো হলো—১. আয়কর আইনের ২৬৬ ধারা অনুসারে জরিমানা, ২. ১৭৪ ধারা অনুসারে কর অব্যাহতির ক্ষেত্র সংকোচন, ৩. মাসিক ২ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ, ৪. পরিষেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া ও ৫. বেতন-ভাতাদি প্রাপ্তিতে জটিলতা ইত্যাদি। (https://www.prothomalo.com/business/personal-finance/mlz5drt2qy)
মন্তব্যঃ
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের রক্তের উপর গঠিত ইন্টিরিম সরকারও জালিম হাসিনার মত পুঁজিবাদী ফ্লাগশিপ প্রতিষ্ঠান আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করে জনগণের আয় এবং ব্যায়ের উপর করের বোঝা বৃদ্ধি করার নীতি অব্যাহত রেখেছে। বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ এবার শুল্ক–কর আদায় আরও বাড়ানোর শর্ত দিল আইএমএফ, ডিসেম্বর ০৮, ২০২৪। হাসিনা সরকার আইএমএফের পরামর্শে শুধু করের নতুন ক্ষেত্র বৃদ্ধি করে নাই বরং নানাবিধ প্রশাসনিক পদক্ষেপের (যেমনঃ আয়-ব্যায়ের সময় অত্যাবশ্যকীয়ভাবে অগ্রীম আয়কর কর্তন) মাধ্যমে জনগণের উপর কর বৃদ্ধি করে জনগণের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে করেছিল সীমিত। হাসিনা সরকার জনগণের উপর করের চাপ এতটাই বৃদ্ধি করে ছিল তা ২০১৩-১৪ অর্থবছর (১ লাখ ৪৯ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা) থেকে ২০২৩-২৪ ( ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৯০ কোটি টাকায়) অর্থবছরের মাত্র ১০ বছরে দ্বিগুণেরও বেশী বৃদ্ধি পায়। বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ https://bonikbarta.com/editorial/T1kAcljtEWQ5xUNO)। জনগণ আশা করেছিল ইন্টিরিম সরকার জালিম হাসিনা কর্তৃক আরোপিত নিপীড়নমূলক করের বোঝা বাতিল করে বা কমিয়ে জনগণকে স্বস্তি প্রদান করে অর্থনীতিকে গতিশীল করবে। কিন্তু, ইন্টিরিম করের বোঝা কমানোর কোন চেষ্টা না করে উপনিবেশবাদী প্রতিষ্ঠান আইএমএফের পরামর্শে জনগণকে কর প্রদানে বাধ্য করতে উপনিবেশীবাদী বৃটিশদের সূর্যাস্ত আইনের (নির্ধারিত সময়ে খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে জমিদারি নিলামে তোলা হতো) মত আয়কর রিটার্ণ দাখিলে অক্ষমতার অপরাধে অতিগুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করে শাস্তি দিতে চাচ্ছে।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিভিন্ন পক্ষকে খুশি করতে রাষ্ট্রের ব্যায় প্রতিবছর বাড়তেই থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে জনগণের উপর কর আরোপ ছাড়া আয়ের বিকল্প কোন উৎস নাই, কারণ সরকার ইতিমধ্যে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে রাষ্ট্রের উৎপাদনমূখী সকল প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিগোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছে। কর আদায়ে তারা বৈষম্য করছে, অর্থাৎ কর আদায়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অবস্থান সকল ক্ষেত্রেই কঠোর হওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ করে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিগোষ্ঠীর স্বার্থে বেশ উদার। উদাহরণস্বরূপ, হাসিনা সরকারের দেশী-বিদেশী বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানীগুলোকে বিশেষ কর সুবিধা প্রদান করেছিল। ইন্টিরিম কেন এই অন্যায় সুবিধা বাতিল করছে না? যদিও, এই বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পগুলো লুটপাটের যন্ত্র হিসেবে সুপরিচিত। বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ ২০৩৬ পর্যন্ত বেসরকারী বিদ্যুৎ কোম্পানীর কর মওকুফ, ২৩ জুন ২০২৩ ইত্তেফাক। আচ্ছা, হয়তো ইন্টিরিম প্রশাসনিক জটিলতার কারণে বিদ্যুৎ কোম্পানীগুলোকে দেয়া হাসিনার অন্যায় সুবিধা বাতিল করতে পারলো না। কিন্তু, ইন্টিরিম কেন নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে দেশী-বিদেশী কোম্পানীগুলোকে নতুন করে কর সুবিধা দিচ্ছে? বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৫ বছর পর্যন্ত কর সুবিধা, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ঢাকা পোষ্ট। সরকার কেন হাইকোর্টকে কোন প্রকার তদন্ত ব্যাতীত ড. ইউনুসের কর পরিশোধের রায় প্রত্যাহারের আদেশ দিল? বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ ড. ইউনূসকে ৬৬৬ কোটি টাকা কর পরিশোধের রায় প্রত্যাহার, অক্টোবর ০৩, ২০২৪, ইত্তেফাক। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক কখনও এই রকম অন্যায্য সুবিধা গ্রহণের বিষয়ে কোন সমালোচনা করে নাই, কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সরকার-ক্ষুদ্র পুঁজিপতিগোষ্ঠী-উপনিবেশবাদী প্রতিষ্ঠানের দুষ্টচক্র সম্মিলিতভাবে জনগণের উপর অর্থনৈতিক জুলুম করে। অর্থনৈতিক জুলুমের জন্মদাত্রী পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ব্যতীত জনগণ পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠীর জুলুম থেকে মুক্তি পাবে না।
ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই শুধুমাত্র জনগণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার করের জুলুম থেকে মুক্তি পাবে। কারণ ইসলামে নাগরিকদের আয় (যেমনঃ আয়কর) এবং ব্যায়ের (ভ্যাট) উপর কর আরোপ নিষিদ্ধ, এবং করের খাত ও পরিমাণ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা দ্বারা নির্ধারিত। নতুন করে কর আরোপ কার ইসলামে নিষিদ্ধ। আবু উবাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন, “অতিরিক্ত কর আরোপকারী জাহান্নামী”। এছাড়াও, উল্লেখ্য ইসলামে সকল প্রকার কর শুধুমাত্র প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের উপর। তাই ইসলামের কর ব্যবস্থা জনগণের উপর কখনও জুলুমমূলক হবে না। উপরোন্তর, ইসলামি ব্যবস্থায় খলিফা মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিকের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই ক্ষেত্রে মুসলিমদের নেতা খলিফা উমর (রা.) একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। “একদা একজন অন্ধ বৃদ্ধ জিম্মী (খিলাফত রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিক) ভিক্ষা করছিলেন। তা দেখে খলিফা উমর (রা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন সে কোন বংশের। সে বলল যে সে ইয়াহূদী। তিনি তাকে ভিক্ষা করার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। সে উত্তর দিল: আমি বৃদ্ধ, কোনো কাজ করতে পারি না। নিজের খরচ ছাড়াও আমাকে জিজিয়া করের জন্য টাকা ভিক্ষা করে তুলতে হয়। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার হাত ধরে তাকে নিয়ে এলেন, যথা সম্ভব দান করলেন। তারপর বায়তুল মালের দায়িত্বশীলকে নির্দেশ দিলেন, এই বৃদ্ধ অন্ধ ইয়াহূদী এবং তার মত অন্যান্য আহলে কিতাবদের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখবে। আল্লাহ্’র কসম! আমরা এই বৃদ্ধের প্রতি ইনসাফ করছি না, অথচ তার যৌবনকালে তার কাছ থেকে কর নিয়েছি আর বৃদ্ধ বয়সে কষ্ট দিচ্ছি”। ইসলামের কর নীতির কারণে জনগণের উপর অপ্রয়োজনীয় আর্থিক বোঝা চাপানোর সুযোগ থাকে না। জনগণের জীবন-যাপন থাকে স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং তৈরি হয় শক্তিশালী অর্থনীতি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, “আর যদি সে সব জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তবে অবশ্যই আমরা তাদের জন্য আসমান ও যমীনের বরকতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম….” [আল-আ'রাফ, ৯৬]
- সিরাজুল ইসলাম
