নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা গণতন্ত্রের সঙ্গে ‘ব্লাসফেমি’: জাহেদ উর রহমান

 


খবরঃ 

বেশ কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা হচ্ছে, হঠাৎ কোনো সামরিক কর্মকর্তার হাত দিয়ে নয়, বরং অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থার মধ্য দিয়েই বিভিন্ন দেশে ডেমাগগরা ক্ষমতায় আসছেন এবং তাদের হাতেই গণতন্ত্র ক্রমাগত ক্ষয় হয়ে নানা ধরনের স্বৈরাচারী ব্যবস্থা মাথাচাড়া দিচ্ছে। একটি ভালো নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়। সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেই একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এগিয়ে যাবে, এ নিশ্চয়তা নেই। এ সত্য মাথা পেতে স্বীকার করে নিয়েও বলছি, ভালো নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপটি দেওয়া সম্ভব নয়। অধিকন্তু, ভালো নির্বাচনকে ছোট করে দেখার কিছু নেই। একটা ভালো নির্বাচনের প্রভাব গভীর ও ব্যাপক। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সরকারের নৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী থাকে। সে রকম একটি সরকার জনস্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে দেশের ভেতরের ও বাইরের যেকোনো শক্তির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে যুদ্ধ করতে পারে। গণতন্ত্রের আলাপ করা হবে, কিন্তু নির্বাচনের প্রয়োজন ও উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না, এ দুটি বিষয় একসঙ্গে চলতে পারে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকে এ ধরনের প্রশ্ন গণতন্ত্রের সঙ্গে পরিষ্কার ‘ব্লাসফেমি”। (https://www.prothomalo.com/opinion/column/i52vzpxjax)

মন্তব্যঃ 

 গণতন্ত্রের পতাকাবাহী এসব একচোখা বুদ্ধিজীবিদের অসততা হল, তারা যদিও প্রচ্ছন্নভাবে স্বীকার করেন যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচার তৈরি হয়, তবুও তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেন ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচার তৈরির কারখানায় পরিণত হয় তা নিয়ে আলোচনা করতে অনিচ্ছুক। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, শাসকের ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার হয়ে ওঠা বা না হওয়ার সাথে নির্বাচনের কোন সম্পর্ক নেই বরং নির্বাচিত হয়ে শাসক কি দিয়ে শাসন করছে সেটার সাথে সম্পর্কিত। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আইন প্রণয়নের সার্বভৌম ক্ষমতা দিয়ে শাসকগোষ্ঠীকে সৃষ্টিকর্তার আসনে বসিয়ে একেকটি দানবে পরিণত করে, যারা জনগণের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন, অধিকার হরণ এবং দমন-পীড়নের মাধ্যমে শুধুমাত্র নিজেদের, ক্ষুদ্র পুঁজিপতিগোষ্ঠীর এবং উপনিবেশবাদীদের স্বার্থরক্ষার জন্য ক্ষমতা আকড়ে ধরে থাকে। আর স্রষ্টাহীন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এই ব্যবস্থার শাসকেরা কারও নিকট থেকে কোন জবাবদিহিতাকে পরোয়া করে না। তাই জনগণের উপর তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন, অধিকার হরণ এবং দমন-পীড়নের মাত্রা যখন পরিপক্ক হয় তখন তা ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়। অতএব, শাসকের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকার অর্থ হল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফ্যাসিবাদের উত্থান অনিবার্য। দশকের পর দশক ধরে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের এই চিত্রই আমরা লক্ষ্য করছি। গণতন্ত্র স্বৈরশাসন, লুটপাট, যুলুম, বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদ ছাড়া কিছুই উপহার দিতে পারেনি। এমনকি বিশ্বের সেরা গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিবেচিত আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬১ সালে সংবিধান লঙ্ঘন করে স্বৈরাচারের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিল। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা আমেরিকায় ‘we are 99%’, ‘black life matters’, ‘Capitol hill riots’ ইত্যাদি  আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে গণতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বৈষম্যমূলক এবং ব্যর্থ। বর্তমানে ৬৪% আমেরিকান বিশ্বাস করে যে মার্কিন গণতন্ত্র সংকটে এবং ব্যর্থতার ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া গণতন্ত্রের আরেক আতুরঘর বৃটেনের কোন সরকারই যখন তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারছে না তখন বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন একে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার লক্ষণ হিসেবে বর্ণনা করেছে! সুতরাং, অপেক্ষাকৃত ভালো গণতন্ত্রের কোন অস্তিত্ব কোথাও নেই। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকানোর চিন্তাও ইউটোপিয়া ছাড়া কিছুই না। তাই জাহেদূর রহমানের মত বুদ্ধিজীবীরা যদি সৎ এবং নিষ্ঠাবান হতেন তাহলে তারা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দশকের পর দশক ধরে অনিবার্যভাবে ফ্যাসিস্ট, স্বৈরশাসক ও যুলুম-বৈষম্যের জন্ম দিয়ে চলেছে সেই ব্যবস্থাকে ডিফেন্ড করার পরিবর্তে এটা কি আদৌ মানবজাতিরকে শাসন করার জন্য উপযুক্ত কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন করতেন। ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরশাসক তৈরির কারখানা এই গণতন্ত্রকে রিফাইন্ড করার প্রেসক্রিপশন দেয়ায় পরিবর্তে নিজেরা এই ব্যবস্থার বিকল্প অনুসন্ধান করতেন এবং জনগণকেও সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন।

প্রকৃতপক্ষে মানবরচিত কোন ব্যবস্থার মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরশাসকের উত্থান ঠেকানো সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু শাসকের চেহারা পরিবর্তন কিংবা ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করলে কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোকে অক্ষত রেখে দিলে সেটা আমাদের জন্য হবে আত্বঘাতী। ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরশাসকের উত্থান ঠেকাতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মূলোৎপাটন করে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত শাসনব্যবস্থা খিলাফত ব্যবস্থার দ্বারা এটাকে প্রতিস্থাপন করে মানুষের সার্বভৌমত্বকে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র কাছে সমর্পণ করতে হবে। কারণ খিলাফত ব্যবস্থায় শাসকের হাতে আইন প্রণয়ণের ক্ষমতা থাকে না, বরং আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র শারীআহ্‌-ই হলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। রাষ্ট্রের খলীফাও যদি এই আইনের উর্ধ্বে উঠতে চায় তাহলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত মাহকামাতুল আল মাযালিম কর্তৃক বিচারের মাধ্যমে তার লাগাম টেনে ধরা হয়। আর আল্লাহ্‌’র কর্তৃত্ব মানেই হচ্ছে জবাবদিহিতা, সুশাসন, শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং সকল প্রকার যুলুম ও বৈষম্য চিরতরে বিলুপ্ত হওয়া। ফলশ্রুতিতে খিলাফত রাষ্ট্রে ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরশাসকের উত্থান অসম্ভব। তাই দেশের জনগণকে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরশাসনকে চিরতরে বিদায় জানাতে হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে খিলাফত ব্যবস্থাকে একমাত্র সমাধান হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ ভন্ড বুদ্ধিজীবীদের তথাকথিত ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও ন্যারেটিভকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। 

    -    কাজী তাহসিন রশীদ


Previous Post Next Post