খবরঃ
‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা-২০২৫’ এ ৮০ শতাংশ নারী ও পোষ্য কোটার প্রথা বাতিল করা, শরীরিক শিক্ষা ও সঙ্গীত বিষয়ে সহকারী শিক্ষক পদ অন্তর্ভুক্ত করা, ১ শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীদের জন্য কোটা রাখা ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় আলেম-উলামারা সঙ্গীত শিক্ষক না দিয়ে প্রতিটি স্কুলে ইসলাম ধর্মের শিক্ষক নিয়োগের দাবী তুলেছেন। (https://todaynewsbd.net/ইসলাম-ধর্ম-শিক্ষক-উপেক্ষ )
মন্তব্যঃ
সরকারী এই উদ্যোগে এবং পাল্টা দাবীতে শিক্ষাসহ দেশের সকল খাতে ইসলামি ও ইসলাম বিরোধী দুটি ধারা সক্রিয় এবং তাদের মধ্যকার স্বার্থের দ্বন্দ্ব দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে এটা ফুটে উঠেছে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক সংকট আলোচনায় আসেনি। শিক্ষা, বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি শিশুর চিন্তাসমূহ তথা ভালো-মন্দ বা সঠিক-ভুল মাপকাঠি (thoughts) এবং পছন্দ-অপছন্দ বা আবেগ-অনুভুতি তথা ঝোঁকসমূহকে (inclinations) গঠন করা। যেহেতু চিন্তা ও ঝোঁক এই দুটি বিষয়ের ভিত্তিতেই মানুষ কাজ করে বা আচরণ করে সেহেতু এই দুটি বিষয়ের সঠিক গঠনের মাধ্যমে একটি সঠিক কার্যকর মানুষ গড়ে তোলা যায়। এরকম একজন মানুষের চিন্তা ও ঝোঁকসমূহ একই উৎস বা ভিত্তি থেকে আসে। ঐ ভিত্তি বা আদর্শটি এমন হওয়া জরুরী যা ব্যক্তিত্বের দুটি উপাদানকে পারস্পারিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গড়ে তোলে। ঐ আদর্শটি মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ হওয়াটাও জরুরী। অন্যথায় মানুষের ব্যক্তিত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংশয়, অস্বাভাবিকতা, জীবনের স্বাভাবিকতায় অনুপ্রেরণার অভাব ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মজার বিষয় হচ্ছে তথাকথিত উন্নত বিশ্ব তথা পশ্চিমে শিশুদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে উপরে উল্লেখিত এই সকল সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে আমেরিকান শিশুদের ৪৯% মানসিক চাপে, ৪২% নিরাশায়, ২৫% মানসিক উদ্বিগ্নতায় এবং ১৪% অবসাদগ্রস্ততায় আক্রান্ত। আমেরিকায় স্কুলগুলোতে গুলি করে বাচ্চাদের মেরে ফেলা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে এফবিআই মনে করে ৮০% ক্ষেত্রে গুলিকারী শিশু মানসিক দ্বন্দ্ব ও সংকটে ভুগছিল। পশ্চিমে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা এতটাই বেগতিক যে ব্রুকিংস এর জরিপ অনুযায়ী মাত্র ১৩% শিশু স্কুলের বিষয়ে উতসাহব্যঞ্চক। OECD দীর্ঘ গবেষনায় এই অনাগ্রহ ও চাপ জনিত সমস্যা খুজে পেয়ে বাচ্চাদের জন্য স্কুলকে আরও আনন্দদায়ক করার জন্য মিউজিক, যৌন শিক্ষা, সরাসরি পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়াসহ নানা উপায় বের করার চেষ্টা করেছে। আমাদের দেশের সরকারও OECD সাজেসশন অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা রিডিজাইন করছে। কিন্তু বলাবাহুল্য এসব উদ্যোগ নতুন সমস্যা তৈরি করছে যেমন পিউ রিসার্চের জরিপ (২০১৯) অনুযায়ী কানাডায় ৮৫% ও যুক্তরাষ্ট্রের ৭২% মানুষ সমকামিতাকে গ্রহণযোগ্য মনে করে। পশ্চিমা বিশ্বের তরুণরা বিয়ে, পারিবারিক বন্ধন এমনকি যৌন সম্পর্কের উপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। অর্থাৎ পশ্চিমা সমাজ দিনে দিনে ভেতর থেকে ভেঙ্গে যাচ্ছে।
আর এসবের মূল কারণ সেক্যুলার আদর্শ কারণ পশ্চিমারা এর ভিত্তিতেই তাদের সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি গঠন করেছে। এই ধর্মনিরপেক্ষতার মূল হলো ধর্মকে সমাজ রাষ্ট্র তথা পাস্পারিক সম্পর্ক তথা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে লাভের ভিত্তিতে এইসকল বিষয়কে পরিচালনা করা। ফলে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হয়ে পড়ে তাদের ব্যবসা বা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য উৎপাদনশীল ও কার্যকরি মানবসম্পদ তৈরি করা। এজন্য তারা স্রষ্টার প্রয়োজনীয়তা এবং স্রষ্ট্রার সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক ও চিন্তাশীল প্রাণী হিসেবে মানুষের প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি সমূহের স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে শুধু মানুষের বাহ্যিক অর্থনৈতিক আচরণের প্রতি বেশী মনোযোগী হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা পুঁজিবাদ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে Academic Capitalism প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর নানা সামাজিক, রাজনৈতিক ফল তৈরি হয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিত্ব গাঠনের দন্দ্ব ও সংঘাত।
সেকুলারিজম একটি ভুল ভিত্তি কারণ এটি মানুষের জীবনের চরম সত্য ও স্বাভাবিকতা স্রষ্টার প্রতি নির্ভরশীলতা, মুখাপেক্ষিতা, দুর্বলতাকে অস্বীকার করে। আর ইসলাম মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কারণ এটি মানুষের দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা ও নির্ভরশীলতাকে স্বীকার করে স্রষ্ট্রার প্রয়োজনীয়তাকে এবং মানুষের প্রবৃত্তি ও সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য স্রষ্ট্রা থেকে আসা একটি ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাকে অবশ্যাম্ভাবী মনে করে। ফলে ইসলাম এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রদান করে যা মানুষের চিন্তাসমূহ এবং ঝোঁকগুলোকে আক্বিদা ও শারীয়া দ্বারা গঠন করে। যেহেতু ইসলামি আক্বিদা এবং শরীয়া সর্বজ্ঞানী আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা থেকে আসা ফলে এতে কোন বৈপরিত্য বা অসামঞ্জস্যতা থাকে না। ফলে এটি একটি শক্তিশালী কার্যকর ব্যক্তিত্ব গঠন করে যা আমরা পুরো ইসলামি খিলাফত জুড়ে দেখতে পাই। ইসলামি রাষ্ট্র তথা খিলাফতে শিশুদেরকে স্কুলে আগ্রহী করে রাখতে ভিন্ন কিছুর আশ্রয় নিতে হয় না কারণ ইসলামি আক্বিদা অনুযায়ী শিক্ষা নিজেই একটি বিশাল অনুপ্রেরণা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “কেউ যদি জ্ঞানার্জনের জন্য একটি পথ অবলম্বন করে আল্লাহ্ তাকে জান্নাতের পথসমূহের একটি পথে স্থাপন করেন” (আবু দাউদ, আহমদ)।
- মোহাম্মদ তালহা হোসেন