খবর:
ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংলাপকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ।…পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশ আশা করে, এই প্রক্রিয়াটি তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা প্রবেশ পুনরায় শুরু এবং গাজার জনগণের দুর্ভোগের অবসান ঘটাবে। বাংলাদেশ আরও আশা করে, সংলাপের মাধ্যমে গাজায় চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে এই কূটনৈতিক প্রক্রিয়া একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত করবে।
গাজায় শান্তি বজায় রাখতে এবং পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে বাংলাদেশ প্রস্তুত বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী সীমান্তের অনুসরণে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি অটল সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে ঢাকা। আর পূর্ব জেরুজালেম হবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী।
(https://www.prothomalo.com/bangladesh/aoexvchvfs )
মন্তব্য:
ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বিবৃতিটি মূলত মার্কিন পরিকল্পনার প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সুস্পষ্ট সমর্থন। প্রধান উপদেষ্টার অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ থেকেও বিবৃতিটি পোস্ট করা হয়েছে।
এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতারণা বুঝতে হলে ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী সীমান্ত ও পূর্ব জেরুজালেম ইস্যু দুটি বুঝতে হবে। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের পরিকল্পনা হলো, ১৯৬৭ সালের সীমান্তের ভিত্তিতে “দুই রাষ্ট্র সমাধান" (Two-State Solution) দিয়ে ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান করা।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের গৃহীত Partition Plan (Resolution 181) ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন অঞ্চলকে দুইভাগে ভাগ করে: ইউরোপ থেকে আগত ইহুদিদেরকে দেয় ৫৬% জমি, অথচ সে সময় তারা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩৩% এবং জমির মালিকানার ছিল মাত্র ৭%। সংখ্যাগরিষ্ঠ ৬৭% আরব মুসলিম, যারা শত শত বছর ধরে ওই অঞ্চলের প্রকৃত অধিবাসী ছিল, তাদেরকে দেওয়া হয় ৪৩% জমি। জেরুজালেম বাকি ১%, আন্তর্জাতিক কর্তৃত্বে।
জাতিসংঘ প্রস্তাবের এক বছরের মধ্যেই ইহুদি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইরগুন ও হাগানাহ আগ্রাসন চালায় ফিলিস্তিনের বিভিন্ন অঞ্চলে। গণহত্যা ও নিপীড়নের মাধ্যমে ইসরায়েল তখন ফিলিস্তিন অঞ্চলের ৭৮% এলাকা দখল করে একটি তথাকথিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে—যা ছিল জাতিসংঘ প্রস্তাবের চেয়েও অনেক বেশি বাড়তি। ফিলিস্তিনিদের দখলে থাকলো কেবল ২২% এলাকা (পশ্চিম তীর ও গাযা)।
১৯৬৭ সালে ইসরায়েল পুনরায় আগ্রাসন চালিয়ে অবশিষ্ট ২২% ফিলিস্তিন এলাকা—পশ্চিম তীর, গাযা ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে।
এরপর থেকে পশ্চিমা বিশ্ব বলা শুরু করলো, “চল, ১৯৬৭ সালের সীমান্তে ফিরে যাই”—অর্থাৎ সেই ভূমিতেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হোক, যা মূল ফিলিস্তিন অঞ্চলের মাত্র ২২% অংশ!
সম্প্রতি ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার মূল ভিত্তি হলো এই ১৯৬৭ সালের সীমারেখা। স্বাধীন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার নামে পশ্চিমা দেশগুলো আসলে মূল ফিলিস্তিনের ৭৮% ভূমিতে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বৈধতা দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমা দেশগুলোর মতো বাংলাদেশ সরকারও এখন অফিসিয়ালি এই অবস্থান গ্রহণ করলো।
পশ্চিমা দেশগুলোর আরেকটি প্রধান শর্ত হলো, হামাসকে অবশ্যই অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে এবং ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে প্রায় নিষ্ক্রিয় বা ক্ষমতাহীন হয়ে যেতে হবে। কথিত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনী (conventional army) থাকবে না। শুধু পুলিশ ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী (internal security forces) থাকবে, যা পশ্চিমা দালাল ফাতাহ নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ-এর অধীনে কাজ করবে। এটি সাধারণ অপরাধ, আইনশৃঙ্খলা এবং অভ্যন্তরীণ হুমকি নিয়ন্ত্রণ করবে।
পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য হলো, ইসরায়েলের কথিত "সেল্ফ-ডিফেন্স রাইট" যেন অটুট থাকে। এই "সেল্ফ-ডিফেন্স রাইট" ব্যবহার করেই ইসরায়েল দশকের পর দশক ধরে, বিশেষত গত দুই বছর, পুরো গাজায় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।
তিন দশক আগে ওসলো অ্যাকর্ডস (১৯৯৩-১৯৯৫)-এও একই ধরনের বিধান রাখা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ-এর নিরাপত্তা বাহিনী শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে। অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলের আগ্রাসী চরিত্র ও ভূমিকাকে অপরিবর্তিত রাখার সব সুযোগ উন্মুক্ত রাখতে চায়। কথিত সেল্ফ-ডিফেন্স রাইট ও ফিলিস্তিন যৌথ নিরাপত্তার মাধ্যমে ইসরায়েলকে ফিলিস্তিন থেকে আসা হুমকির বিরুদ্ধে "প্রতিরক্ষামূলক" অ্যাকশন নেওয়ার অধিকার দেওয়া থাকবে। সীমান্ত নিরাপত্তা, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং প্রয়োজনে সীমিত সামরিক অভিযানের এখতিয়ার থাকবে ইসরায়েলের।
এভাবে পশ্চিমাদের Two-State সমাধানে ফিলিস্তিনকে নিরস্ত্র ও ডিমিলিটারাইজড করা হবে এবং ইসরায়েলের "প্রতিরক্ষা" ও "আক্রমণাত্মক" ক্ষমতা সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রাখা হবে। আরবের গাদ্দার শাসকেরা আরব পিস ইনিশিয়েটিভ (API)-এর নামে ইসরায়েলকে নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিতে সম্মত আছে, যদি ইসরায়েল স্রেফ ১৯৬৭-এর অধিকৃত ভূমিগুলো ছেড়ে দেয়।
অর্থাৎ "স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র"-কে স্বীকৃতি ও "দুই রাষ্ট্র সমাধান"-এর নামে পশ্চিমা বিশ্ব ও আরবের দালাল সরকারগুলো আসলে যা চায়:
১. "স্বাধীন ফিলিস্তিন" নামে একটি দুর্বল, ক্ষুদ্র, সামরিক শক্তিহীন, পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরায়েল-নির্ভর একটি ছদ্ম রাষ্ট্র (pseudostate) প্রতিষ্ঠা করা।
২. ইসরায়েলকে নিরাপদ, আগ্রাসী ও শক্তিশালী করা।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারও এখন একই পরিকল্পনায় সমর্থনের কথা জানাল। কিন্তু আরব ও মুসলিম দেশগুলোর দালাল শাসকদের এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে না। এমনকি ফিলিস্তিনের কতিপয় ব্যক্তিও যদি ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সম্মত হয়, তবুও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে না। যেমনটা শহীদ ইয়াহিয়া সিনওয়ার বলে গেছেন, "এই শহর (জেরুজালেম-গাজা) সমস্ত স্বাভাবিকীকরণকারীকে প্রকাশ করে দেবে, সব দালালের মর্যাদাহানি করবে এবং যারা আত্মসমর্পণ ও সমঝোতা করে তাদের আসল চেহারা উন্মোচন করবে।"
ফিলিস্তিন সংকটের প্রকৃত সমাধান হতে হলে এই সংকটের মূল কারণ — ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের একতরফা সাম্রাজ্যবাদী প্রস্তাব, ১৯৪৮ সালের অন্যায় দখলদারিত্ব ও অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র — ইত্যাদির পরিবর্তন, বিচার ও উচ্ছেদ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। পশ্চিমা বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত বর্তমান বিশ্ব কাঠামোয় সেটি আসলে সম্ভব নয়। কেবলমাত্র আসন্ন পরবর্তী খিলাফত এই ফিলিস্তিন সমস্যার প্রকৃত সমাধান করতে পারবে।
- রাশিদ হাসান মেহেদী
