গাজীপুরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রাউন্ড স্টেশন বসাচ্ছে স্টারলিংক, ইন্টারনেট সেবা দিতে চায় পার্শ্ববর্তী দেশেও

 

খবরঃ 

সিঙ্গাপুরকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে ভুটানসহ পার্শ্ববর্তী দেশে ইন্টারনেট সেবা দিতে চায় স্টারলিংক। এ লক্ষ্যে গাজীপুরে হাইটেক পার্কে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রাউন্ড স্টেশন বসানোর পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানটির। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) দেয়া চিঠিতে, বাংলাদেশকে হাব করে অন্য দেশে ডাটা পরিবহনের অনুমোদন চেয়েছে তারা। যেখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তবে, স্টারলিংকের আবেদনের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা...  চিঠিতে সামিট, ফাইবার অ্যাট হোম ও বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি থেকে আইপিএলসি এবং আনফিল্টারড আইপি ব্যন্ডউইথ কিনে বাংলাদেশের গেটওয়ে থেকে সিঙ্গাপুর ও ওমান পপে ডাটা পরিবহন করার অনুমতি চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। (https://www.amadershomoy.com/tech/article/160178/গাজীপুরে-বিশ্বের-সবচেয়ে)

মন্তব্যঃ  

স্টারলিংকের গাজীপুরে হাইটেক পার্কে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রাউন্ড স্টেশন বসানোর পরিকল্পনাকে শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশের ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হিসেবে অনেকে মনে করলেও এর পিছনে রয়েছে মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের এক বিস্তর পরিকল্পনা। নেত্র নিউজের “স্টারলিংক নিয়ে গর্জন বেশি, বর্ষাবে কতটা?” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “গত ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ইউনূস স্টারলিংক বাংলাদেশের ডিজিটাল জগতে বিপ্লব আনবে বলে উল্লেখ করেন……কিন্তু, স্টারলিংককে নিয়ে এমন ডামাডোল ও রাষ্ট্রীয় প্রচারণার অন্তরালে রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতা, যা বহুমাত্রিক সংকট, সীমাবদ্ধতা এবং নাগরিকদের প্রযুক্তিগত স্বাধীনতাকে জিম্মি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, বাংলাদেশের স্টারলিংকের প্রযুক্তি ‘রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি”। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোন সরকার নেটওয়ার্ক শাটডাউন না করতে পারার যে বক্তব্য ড. ইউনূস দিয়েছেন তাও সত্য নয়। 


বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের দুষ্ট নীল-নকশাকে বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করলে এটি দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে উঠে কেন মার্কিন কোম্পানি স্টারলিংক বাংলাদেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি করে চাচ্ছে(!)। মূলত, ২১শ শতাব্দীর ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রস্থল ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকা তার আধিপত্য বিস্তারে এবং চীনের ক্রমবর্ধমান উত্থানকে লাগাম টানতে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (IPS) হাতে নিয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এই অঞ্চলকে ঘিরে আমেরিকা ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াক নিয়ে কোয়াড (Quadrilateral Security Dialogue – QUAD) গঠন করেছে, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে ত্রিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তি AUKUS করেছে, এবং ASEAN দেশগুলোর সাথে বেশকিছু কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সিকিউরিটি আল্যায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে যার মূল উদ্দেশ্য এই অঞ্চলকে ঘিরে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI), দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ ও সেনা ঘাঁটি স্থাপন, তাইওয়ান প্রণালীতে চাপ সৃষ্টি, এবং ডেব্ট-ট্র্যাপ কূটনীতি একগুলোকে মোকাবেলা করা। আর আমেরিকার এই নীল-নকশা বাস্তবায়নের অন্যতম মূল কেন্দ্রবিন্দু্তে আছে বাংলাদেশ। কেননা, বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত — একদিকে ভারত, অন্যদিকে মিয়ানমার ও বঙ্গোপসাগর।  বঙ্গোপসাগরকে “gateway to the Indo-Pacific” বলা হয়, কারণ এখান দিয়েই চীন, ভারত, জাপান, ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাহাজ চলাচল করে। বাংলাদেশ ভারত মহাসাগরের sea lane of communication (SLOCs)-এর কাছাকাছি, যা বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৭০% পণ্য পরিবহন করে। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে, বাংলাদেশ হলো এক ধরনের “Strategic Maritime Hub” যা ভারত মহাসাগরের উত্তরে প্রবেশের একটি মূল পথ। তাই আমেরিকা বাংলাদেশকে IPS-এর maritime security cooperation, counter-terrorism, cyber-security উদ্যোগে যুক্ত করতে চাচ্ছে।  এই উদ্যোগেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গাজীপুরে স্টারলিংকের গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন। কারণ, এই স্টেশন U.S. Coast Guard-কে সহযোগিতা, ও Bay of Bengal maritime surveillance — তথা IPS-এর digital connectivity ও regional security অংশের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। পাশাপাশি, এর মাধ্যমে আমেরিকা বাংলাদেশকে চীনের ডিজিটাল সিল্ক রোড(DSR) প্রকল্পের নির্ভরতা থেকে বের করে মার্কিন নির্ভর করতে চাচ্ছে। বর্তমানে, বাংলাদেশের প্রায় ৭০% মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর ( যেমন Grameenphone, Banglalink, Robi) এবং একটি বড় অংশের ফিক্সড-লাইন ইনফ্রাস্ট্রাকচার হুয়াওয়ে দ্বারা সরবরাহকৃত ও পরিচালিত। হুয়াওয়ে বাংলাদেশে 5G নেটওয়ার্ক পরীক্ষা ও স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তারা টেলিটক-এর সাথে যৌথভাবে বাংলাদেশে প্রথম 5G ট্রায়াল চালু করে। তাই, আমেরিকা স্টারলিংককে এই অঞ্চলে চায়না নেটওয়ার্কের (হুয়াওয়ে, ZTE) বিকল্প হিসেবে ড. ইউনূসের সহযোগিতায় নিয়ে এসেছে। যা মূলত, তারই ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যবহৃত হবে। সুতরাং, এই স্টেশন যতটা না আমদেরকে প্রযুক্তি গত উন্নতির স্বপ্ন দেখাচ্ছে তার চেয়ে বেশি আমাদেরকে আমেরিকান স্বার্থ হাসিলের ঘুঁটিতে পরিণত করছে। যা প্রকৃত অর্থেই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরুপ। প্রযুক্তিগত এই উন্নতির নামে দেশের সার্বভৌমত্ব মুসলিমদের সবচেয়ে বড় শত্রু মার্কিনীদের হাতে তুলে দেওয়ার মাঝে দাসত্ব না মুক্তি রয়েছে সচেতন ব্যক্তিবর্গের তা বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়। 

    -    আসাদুল্লাহ্‌ নাঈম


Previous Post Next Post