খবরঃ
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে নিহত হওয়া ব্যক্তির পরিবারকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক ও রেল উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। একই সঙ্গে ওই পরিবারে চাকরিক্ষম কোনো ব্যক্তি থাকলে তাকে মেট্রো রেলে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি। আজ রবিবার দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল মেট্রো রেলের ফার্মগেট স্টেশন পরিদর্শনে এসে তিনি এ কথা বলেন। (https://www.kalerkantho.com/online/dhaka/2025/10/26/1597139)
মন্তব্যঃ
একজন সুস্থ সবল মানুষ ফুটপাথে হাঁটার সময় আচমকা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাডের আঘাতে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু, দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের শাস্তি হওয়া দূরের কথা কাউকে অভিযুক্তও করা হলো না। রাষ্ট্র মাত্র পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করার মাধ্যমে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দায় মুক্তি দিচ্ছে। সেকুলার রাষ্ট্রের এই দায় মুক্তির সংস্কৃতির জন্য জনগণের প্রাত্যহিক জীবন বিপদসংকুলে পরিণত হয়েছে। রাস্তার ম্যানহলে পরে মৃত্যু, সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ি বা রেলের নিচে পিষ্ঠ হয়ে মৃত্যুসহ বিভিন্ন সরকারী স্থাপনা বা পরিবহণ থেকে মৃত্যু এখন প্রতিদিনের ঘটনা। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এই অবহেলা জনিত মৃত্যুর ঘটনাগুলো সংবাদপত্রে নিউজ হিসেবেও আসেনা। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সংস্থার ভুল বা কারও অসচেতনতায় ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগীরা কোন ক্ষতিপূরণই পায় না কারণ বাংলাদেশের সংবিধান বা প্রচলিত সেকুলার আইনে রাষ্ট্রের অবহেলা বা ভুলের ক্ষতিপূরণ চাওয়ার আইনি কাঠামো খুবই দুর্বল। যেটুকু সুযোগ আছে, তাতে ক্ষতিপূরণ পেতে গুনতে হয় প্রতীক্ষার দীর্ঘ প্রহর। বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ ক্ষতিপূরণ পেতে দীর্ঘ হয় ক্ষত, দেশ রূপান্তর, ০৭ মার্চ ২০২৪। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর আওতায় গাড়ীর মালিক এবং শ্রমিকদের নিকট থেকে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়। কিন্তু, প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থ থাকার পরও ভুক্তভোগীরা এই তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না। বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ধীরগতি, প্রথম আলো, ১৮ জানুয়ারি ২০২৪। সরকারের তরফ থেকে এই প্রক্রিয়াগত জটিলতা দূর করার জন্য কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। বরং, যখন কোন দুর্ঘটনা ভাইরাল হয় জনগণ বিষয়টি নিয়ে কথা বলে শুধুমাত্র তখনই সরকার ক্ষতিপূরণ প্রদানের নাটক মঞ্চস্থ করার মাধ্যমে জনগণের ক্ষোভকে প্রশমিত করার চেষ্টা করে।
এর বিপরীতে, ইসলাম শুধুমাত্র মানুষের জীবনের নিরাপত্তাই নয়, এমনকি পশু-পাখীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে শাসকের দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মুসলিমদের নেতা খলিফা উমর (রাঃ) তার খিলাফতের দায়িত্বে থাকাকালীন সময় একদিন বলেন, “ফোরাতের তীরে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মারা যায়, তবে কিয়ামতের দিন উমরকে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে।” পশুর জীবনের মূল্য নিয়ে যে শাসন ব্যবস্থায় শাসক আল্লাহ্’র নিকট জবাবদাহিতার ভয় করে, সেই শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় স্থাপনার নির্মাণ বা ব্যবস্থাপনা অবহেলাজনিত দুর্ঘটনায় মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে তা অনুমান করে দেখুন। আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে কাবা ঘর তাওয়াফ করতে দেখলাম এবং তিনি বলছিলেন, “কত উত্তম তুমি হে কাবা! কত আকর্ষণীয় তোমার খোশবু, কত উচ্চ মর্যাদা তোমার (হে কাবা)! কত মহান সম্মান তোমার। সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! আল্লাহ্’র নিকট মুমিন ব্যক্তির জান-মাল ও ইজ্জতের মর্যাদা তোমার চেয়ে অনেক বেশী।” রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় দুর্ঘটনার দায় শাসক, স্থাপনা নির্মাণ-পরিচালনা-তত্ত্বাবধানের সাথে জড়িত কেউ এড়াতে পারবে না। জড়িত সকলকে এর জন্য জবাবদাহিতা করতে হবে। শুধু তাই নয় বিষয়টি অনিচ্ছাকৃত হলেও, ঘটনাটির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দিয়াহ (রক্তমূল্য) প্রদান করতে হবে। একজন মুসলিমের দিয়াহ হচ্ছে ১০০ টি উট বা ২০০ টি গরু বা ১, ০০০ দিনার বা ১০,০০০ দিরহাম। বর্তমান বাজার মূল্য বিবেচনা করলে একজন মুসলিম ব্যাক্তির দিয়াহ্ হবে প্রায় ২ কোটি টাকা। ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের তার অবহেলার মাত্রা অনুযায়ী দিয়াহ’র অংশ প্রদান করতে হবে। ইসলামের হুকুমের বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা উপস্থাপন করার জন্য খলিফা হারুন অর রশীদের সময়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ঘটনাটি তৎকালীন সিরিয়ার রাকা শহরের। ঐ শহরের বিচারক অসুস্থার কারণে দীর্ঘদিন বিচারকার্য বন্ধ ছিল। খলিফা হারুন অর রশীদ শূন্যস্থান পূরণের জন্য নতুন বিচারকের ব্যবস্থা করলেন। দিন কয়েক যেতেই প্রহরীরা এক বৃদ্ধা মহিলাকে আসামি হিসেবে দরবারে হাজির করলেন। বৃদ্ধা শহরের এক রেস্তোরাঁ থেকে রুটি আর মধু চুরি করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন। বিচারে বৃদ্ধা স্বীকার করলেন এবং তিনি বলেন গত এক সপ্তাহ তিনি এবং তার সঙ্গে থাকা এতিম দুই নাতিও অনাহারে দিনযাপন করছিল। ওদের ক্ষুধার্ত চেহারা ও কান্না সহ্য করতে না পেরেই বৃদ্ধ মহিলা চুরি করেন। বৃদ্ধার কথা শুনে বিচারক পুরো দরবারে চোখ বুলালেন। ঘোষণা দিলেন, কাল যেন নগর, খাদ্য, শরিয়া, নিরাপত্তা প্রধান এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকেন। সবার সামনে বৃদ্ধ মহিলার চুরির রায় ঘোষণা করা হবে। পর দিন সকালে সবার উপস্থিতিতে বিচারক রায় ঘোষণা করলেন- ‘বৃদ্ধ মহিলার চুরির অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৫০টি চাবুক, ৫০০ রৌপ্যমুদ্রা আর অনাদায়ে এক বছর কারাদন্ড দেওয়া হলো। তবে সত্য স্বীকার করায় হাত কাটা মাফ করা হলো।’ বিচারক প্রহরীকে চাবুক আনার নির্দেশ দিয়ে নিচে নেমে ওই বৃদ্ধ মহিলার পাশে দাঁড়ালেন। বিচারক বললেন, যে নগরে একজন ক্ষুধার্ত বৃদ্ধ মহিলা না খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় চুরি করতে বাধ্য হন সেখানে সবচেয়ে বড় অপরাধী সে দেশের খলিফা। আর আমি এসেছি খলিফার প্রতিনিধি হয়ে। তাই ৫০টি চাবুকের ২০টি আমার হাতে মারা হোক। আদেশ অনুযায়ী বিচারকের হাতে ২০টি চাবুক মারা হলো। চাবুকের আঘাতে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কেউ একজন বিচারকের হাত বাঁধার জন্য এগিয়ে গেলে বিচারক নিষেধ করেন। এরপর বিচারক বললেন ‘যে শহরে নগরপ্রধান, খাদ্যগুদাম প্রধান ও অন্যান্য সমাজ বিশিষ্ট একজন অভাবগ্রস্ত মহিলার ভরণ-পোষণ করতে পারেন না, সেই নগরে তারাও অপরাধী। তাই বাকি ৩০টি চাবুক সমানভাবে তাদের মারা হোক।’ এরপর বিচারক নিজ পকেট থেকে বের করা রুমালের ওপর ৫০টি রৌপ্যমুদ্রা রাখলেন। তারপর বিচারপতি উপস্থিত সবাইকে বললেন, ‘যে সমাজ একজন বৃদ্ধ মহিলাকে চোর বানায়, যে সমাজে এতিম শিশুরা উপবাস থাকে সে সমাজের সবাই অপরাধী। তাই উপস্থিত সবাইকে ১০০ দিনার রৌপ্যমুদ্রা জরিমানা করা হলো।’ এবার মোট ৫০০ দিনার রৌপ্যমুদ্রা থেকে ১০০ দিনার রৌপ্যমুদ্রা জরিমানা বাবদ রেখে বাকি ৪০০টি রৌপ্যমুদ্রা থেকে ২০টি চুরি যাওয়া দোকানের মালিককে দেওয়া হলো। বাকি ৩৮০টি রৌপ্যমুদ্রা বৃদ্ধাকে দিয়ে বললেন ‘এগুলো আপনার ভরণ-পোষণের জন্য। আর আগামী মাসে আপনি খলিফা হারুন অর রশীদের দরবারে আসবেন। খলিফার পক্ষ থেকে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী’। এক মাস পরে বৃদ্ধা খলিফার দরবারে গিয়ে দেখেন- খলিফার আসনে বসা সেই লোকটি যিনি তার বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন। খলিফা চেয়ার থেকে নেমে এসে বললেন, আপনাকে ও আপনার এতিম দুই নাতিকে অনাহারে রাখার জন্য সেদিন বিচারক হিসেবে ক্ষমা চেয়েছি। আজ দরবারে ডেকে এনেছি। প্রজা অধিকার সমুন্নত না করায় অধম এই খলিফাকে ক্ষমা করে দিন। এটাই হচ্ছে ইসলামী শারীআহ্’র নীতি যা খিলাফত রাষ্ট্রের মাধ্যমে নিশ্চিত হবে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের সেই বরকতময় খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন।
- মো: সিরাজুল ইসলাম
