খবরঃ
বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘিরে ‘মহাপরিকল্পনা’ নিয়ে এগোচ্ছে ভারতসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশের কিছু রাজনীতিবিদ ও সংগঠন। গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রেরণের জন্য ১০ পৃষ্ঠার কার্যবিবরণী প্রস্তুত করে। এতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন ও ব্যক্তির নানামুখী অপতৎপরতা তুলে ধরে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক, কিছু বামপন্থি সংগঠন ও দেশি-বিদেশি কয়েকটি এনজিও পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। তারা চাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘পূর্ব তিমুর কিংবা দক্ষিণ সুদান’-এর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনের বর্ণনা দিয়ে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘অতি গোপনীয় এ কার্যবিবরণীতে। (https://www.dailyamardesh.com/amar-desh-special/amd9czk5hlc3r)
মন্তব্যঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা ও বিদেশী ষড়যন্ত্র বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই শুরু। ১৭৬০ সালে বৃটিশরা বাংলার নবাব মীর কাসেমের নিকট থেকে চট্টগ্রামের শাসনভার অর্জন করার পর থেকেই আরাকান ও ভারত থেকে পার্বত্যাঞ্চলে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে আশ্রয় নেয়া চাকমা, মারমা, ম্রো, ও ত্রিপুরাদের মত বিভিন্ন উপজাতিগোষ্ঠীদেরকে অত্যাচার ও নিপীড়ন শুরু করে। ১৮৬০ সালে বৃটিশরা ‘বিভক্ত করে শাসন করার (Divide and Rule) কৌশল হিসেবে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা থেকে বিভক্ত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম (Chittagong Hill Tracts) নামক স্বতন্ত্র জেলার জন্ম দেয়। ১৮৯২ সালে কলকাতায় চিন-লুসাই কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলা, মায়ানমার ও ভারতের মধ্যে বিস্তৃত কুকি-চিন-মিজো নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত লুসাই পাহাড়কে ৩ দেশের মধ্যে ভাগ করে সীমান্ত রেখা টেনে দিয়ে এই নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে ভুমি অধিকার বঞ্চিত হওয়ার অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (Chittagong Hill Tracts Regulation 1900) চালু করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল বানানোর চেস্টা করে এবং বাঙালিদের প্রবেশ, জমি ক্রয় ও বসতি স্থাপনে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যে ঘৃণ্য বিভাজন নীতিই “পাহাড়ি বনাম সেটেলার” নামক দ্বন্দ্বের মানসিক ভিত্তি তৈরি করেছে। পাকিস্তান ও তৎপরবর্তী বাংলাদেশের শাসকরাও দেশের পার্বত্য অঞ্চলকে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোন থেকেই বিবেচনা করে। পাকিস্তান সরকার পার্বত্যাঞ্চলে আবারও বাঙালি বসতি অনুমোদন দিলে অনেক পাহাড়ি পরিবার ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয় এবং তাদের অনেক জমি খাস জমি হিসেবে নথিভুক্ত হয়। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই হ্রদ প্রকল্পের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৪০% উর্বর ভূমি(৫৪০০০ একর) পানিতে তলিয়ে যায় এবং প্রায় ১ লক্ষ পাহাড়িও মানুষ বাস্তুচ্যুত হলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই জনগোষ্ঠীকে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেনি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে “বাঙালি জাতীয়তাবাদ”কে একমাত্র জাতিসত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্র যখন সব নাগরিকদেরকে হঠাৎ করে বাঙালি বলতে চায় তখন পাহাড়িদের মধ্যে পাহাড়ি জাতিস্বত্বা ও স্বায়ত্বশাসনের চেতনা জাগ্রত হয়। ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পার্বত্য চট্রগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) প্রতিষ্ঠা করে পার্বত্য অঞ্চলের আলাদা স্বায়ত্বশাসনের দাবি নিয়ে শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করলে শেখ মুজিব মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে ধমক দিয়ে বলেঃ “স্বায়ত্বশাসনের কথা ভুলে বাড়ি ফিইরা যা, আর যা বাঙালি হইয়া যা’। স্বায়ত্বশাসনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ভাই সন্তু লারমার নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালে গঠিত জেএসএসের সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। শেখ মুজিবের পর জিয়া ও এরশাদও পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েক লাখ বাঙালি প্রবেশ করিয়ে পাহাড়ের ডেমোগ্রাফি পরিবর্তনের চেস্টা করে। এভাবে পাহাড়ি-বাঙালি বিভাজন নিরসন সহ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপযুক্ত বাসস্থান, ভূমির অধিকার ও মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে তাদের বঞ্চনা ও ক্ষোভকে সমাধানের পরিবর্তে পতিত হাসিনা সরকার ১৯৯৭ সালে শান্তিবাহিনীর সাথে “পার্বত্য চট্রগ্রাম শান্তি চুক্তি”স্বাক্ষর করে পার্বত্যাঞ্চল থেকে আমাদের সামরিক বাহিনীকে প্রত্যাহার করে দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এই শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে ধারাবাহিকভাবে ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ(গণতান্ত্রিক), জেএসএস (সংস্কারপন্থী), মগ লিবারেশন পার্টি ও কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে বিভিন্ন সশস্ত্র এবং বিছিন্নতাবাদী সংগঠন তৈরি হয় যাদেরকে ঔপনিবেশিক বৃটেন ও আমেরিকা নিজ নিজ ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ে ইন্ধন দিচ্ছে।
জেএসএস এবং জেএসেস ভেঙ্গে জন্ম নেওয়া ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ(গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস(সংস্কারপন্থী) এগুলোর প্রত্যেকে বৃটেনের মদদপুস্ট। ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির পরে হাসিনা সরকার ধারাবাহিকভাবে পার্বত্যাঞ্চল থেকে ২৪৬ টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে এবং শান্তিবাহিনী পুরোপুরিভাবে অস্ত্র সমর্পণ না করা স্বত্বেও এই বাহিনীর প্রধান সন্তু লারমাকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা সহ সকল রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা প্রদান করে। এছাড়া ইউপিডিএফ পাহাড়ে হত্যা, নাশকতা ও সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায় রেকর্ড গড়লেও হাসিনা সরকার ২০২২ সালে ইউপিডিএফের দেয়া নতুন শান্তি প্রস্তাব আমলে নেয়। এভাবে এসব সশস্ত্র গ্রুপগুলোর পেছনে বৃটিশ সমর্থনের বিষয়টি স্পস্ট হয় যার কারণে বৃটেনের দালাল হাসিনা ছিল এদের প্রতি সহনশীল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা এক্ট ২০২২ পাস হওয়ার পর পার্বত্যাঞ্চলে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করা কুকি-চীন-ন্যাশনাল ফ্রন্ট, মগ লিবারেশন পার্টি এবং আরাকান আর্মি হচ্ছে মার্কিন মদদপুস্ট যার ফলে বর্তমান মার্কিন অনুগত অন্তর্বর্তী সরকার এদের প্রতি সহনশীল। বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় আসা বৃটেন-আমেরিকার দালাল শাসকদের কেউই তাদের প্রভুর মদদপুস্ট বিবেচনায় পার্বত্য অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীদেরকে উপযুক্ত সামরিক অভিযানের মাধ্যমে নির্মূলের জন্য আমাদের সামরিক বাহিনীর পূ্র্ণ সক্ষমতাকে ব্যবহার করেনি। যার ফলে পার্বত্যাঞ্চলে ঔপনিবেশিক শক্তির ইন্ধনে বিভিন্ন সশস্ত্রগোষ্ঠীর তৎপরতায় আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব আজও হুমকির সম্মুখীন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা এবং এ অঞ্চলকে ঘিরে ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করতে পারবে একমাত্র খিলাফত রাষ্ট্র। খিলাফত রাষ্ট্র পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের মত ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষকে “জিম্মাহ” চুক্তির অধীনে ভূমি ও অন্যান্য নাগরিক অধিকার প্রদানের পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় আচার পালন ও জাতি-বর্ণ-গোষ্ঠিগত পরিচয় বজায় রাখার অধিকার দিয়ে ইসলামের শক্তিশালী ব্যানারের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করবে। যার ফলে এই রাষ্ট্রকে তারা নিজেদের রাষ্ট্র বলে মনে করবে ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হবে। পার্বত্যাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন সহ এ অঞ্চলের সকল সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলোকে গ্রেফতার ও শিকড়সহ নির্মূল করার জন্য খিলাফত রাষ্ট্র তার সর্বশক্তি নিয়োগ করবে কারণ মুসলিম ভূ-খন্ড থেকে ইঞ্চি পরিমান ভূমি বিচ্ছিন্ন হওয়াও ইসলামী শারীআহ্ বৈধতা দেয়না। এসব সন্ত্রাসীগোষ্ঠীকে নির্মুলের ক্ষেত্রে কে কোন পরাশক্তির মদদপুস্ট সেটা বিবেচনা করার সুযোগ নেই কারণ খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিতই হবে সব পরাশক্তিগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে। তাই খিলাফত রাষ্ট্রের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পার্বত্যাঞ্চল থেকে ইতিমধ্যে প্রত্যাহার করা ২৪৬টি সেনা ক্যাম্প পুনঃস্থাপন সহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনাক্যাম্প এবং এ অঞ্চলে সেনানিবাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে। এছাড়া খৃস্টান মিশনারী, এনজিও ও বিদেশী সাহায্য সংস্থাগুলোকে বন্ধ ঘোষণার পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রকৃত মদদদাতা মার্কিন-বৃটেনকে শত্রু রাষ্ট্র ঘোষণা করে এদেশে তাদের এম্বাসীগুলো বন্ধ করে দিয়ে তাদের সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদি সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলোর সকল সংযোগ ও সাপ্লাই লাইন চূড়ান্তভাবে কেঁটে দিবে। দীর্ঘকালের অমীমাংসিত পার্বত্য চট্টগ্রাম (পাহাড়) সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে খিলাফত রাষ্ট্রের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব যেমন সুরক্ষিত হবে, তেমনি মুসলিম- অমুসলিম ও ভিন্ন জাতিস্বত্তার মানুষজন অচিরেই আবারও ইসলামের স্বর্ণযুগে প্রবেশ করবে এবং পৃথিবীতে নেতৃত্বশীল জাতি হিসেবে আবির্ভুত হয়ে কোনরূপ বৈষম্য ছাড়াই ইসলামী ব্যবস্থার বিভিন্ন সুবিধাদি, তাদের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের পরিপূর্ণ সুরক্ষাসহ প্রশান্তিময় জীবন অতিবাহিত করতে শুরু করবে ইনশাল্লাহ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “আল্লাহ আমাকে পৃথিবী দেখিয়েছেন, সুতরাং আমি এর পূর্ব এবং পশ্চিম পর্যন্ত দেখেছি, এবং আমাকে দেখানো স্থানসমূহে আমার উম্মাহর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে” (মুসলিম)
- কাজী তাহসিন রশীদ
