ইউনিয়নে রাজনীতি থাকলে স্বাধীন সাংবাদিকতা কীভাবে হবে: মাহ্‌ফুজ আনাম



খবরঃ

বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার অন্তরায় হিসেবে সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাকেও দায়ী করছেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম। তিনি বলেছেন, ‘যত দিন পর্যন্ত আমার সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো রাজনৈতিক ভিত্তির ওপরে নির্ভর করে বিভক্ত থাকবে, তত দিন পর্যন্ত স্বাধীন সাংবাদিকতা হবে না।’ গণমাধ্যমগুলোর কাজ কীভাবে চলবে, তা নিজেদেরই ঠিক করে নেওয়ার পক্ষে মত জানিয়ে তিনি কিছু বিষয়ের উল্লেখ করে বলেন, ‘সাংবাদিকতার এথিক্স, সম্পাদকের এথিক্স, মালিকের এথিক্স; মালিকের কোথায় অধিকার কতটুক থাকবে, কতটুক থাকবে না; সম্পাদকের কী দায়িত্ব এবং সাংবাদিকদের কী দায়িত্ব।’ (https://www.prothomalo.com/bangladesh/pjvtac0x9n)

মন্তব্যঃ

মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে হলে, সাংবাদিকতাকে হতে হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। সাংবাদিক, সম্পাদক ও মালিক-সকলকে হতে হবে ‘এথিক্স’সম্পন্ন। ---- এই কথাগুলো শ্রুতিমধুর তরঙ্গ তুললেও, এর শ্রুতিমাধুর্য্যে হারিয়ে না গিয়ে এই কথাগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর খোঁজা প্রয়োজন। “মত প্রকাশের স্বাধীনতা”, “ব্যক্তিস্বাধীনতা”, “মালিকানার স্বাধীনতা” এবং “বিশ্বাসের স্বাধীনতা”- এই সকল স্বাধীনতা রক্ষা হলেই যে সমাজে ইতিবাচক সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটবে এটা কি ধ্রুব সত্য? এটা মূলতঃ কার বা কাদের মত? ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই জানা যায় যে চার্চের পাদ্রিদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে জন লক, জন স্টুয়ার্ট মিল এবং ভলতেয়ারদের মনগড়া তত্ত্ব হল এই স্বাধীনতা তত্ত্ব। এই স্বাধীনতা তত্ত্ব খুবই শ্রুতিমধুর হলেও বাস্তবে এর সামগ্রিক প্রয়োগ অসম্ভব। মাহফুজ আনামের অভিপ্রায়কেই উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যাক। একটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সবই ব্যবসা। শিক্ষা, চিকিৎসা এবং সাংবাদিকতাও মুনাফা কামানোর মাধ্যম। এটাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জীবনের লক্ষ্য। মাহফুজ আনাম সাহেবদের ভুলোমনকে স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে হাসিনাকে দুর্নীতিবাজ উল্লেখ করা, আবার হাসিনার আমলে হাসিনাকে দুর্নীতিবাজ বলাকে ভুল বলে মেনে নেয়া, এবং আবার হাসিনা পতনের পর “চাপে ছিলাম তাই বলতে পারিনি” – এসকল কিছুই তো মুনাফা রক্ষারই প্রয়াস। কারণ সরকারি ও দেশী-বিদেশি কোম্পানির বিজ্ঞাপনের কাছে কি তার “স্বাধীন সাংবাদিকতা” জিম্মি না?? অর্থাৎ, মুনাফা অর্জনের স্বাধীনতা সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে হারিয়ে দিচ্ছে। এরকম দুইটা স্বাধীনতায় ঠোকাঠুকি লাগলে কোন স্বাধীনতা প্রাধান্য পাবে? সম্পাদক, মালিক, সাংবাদিক কে কোন স্বাধীনতার পিছনে দৌঁড়াবে?

মূলতঃ মানুষ বা মানুষের সমাজের জন্য কোনটা ভালো বা কোনটা বর্জনীয় এটা নির্ধারণ করতে হলে, মানুষকে সেই ভালো বা মন্দের সাথে জীবনের উদ্দেশ্যকে প্রাসঙ্গিক করে দিতে হয়। যেমন জন লক, ভলতেয়ারদের মন থেকে উদ্ভূত স্বাধীনতা তত্ত্বে মানুষের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে স্বাধীনভাবে বাঁচা। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা শুধু ক্ষমতাসীন এবং ধণী মানুষদের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব। তাই মানুষের জীবনের লক্ষ্য হয়ে গেল ক্ষমতা, সম্পদ বা মুনাফা অর্জন। মুনাফা অর্জনই যেই তত্ত্বের একমাত্র লক্ষ্য সেখান থেকে ম্যাকিয়াভেলিয়ান এথিক্স (জোর যার মুল্লুক তার, লক্ষ্য পূরণের জন্য যেকোন উপায়ই গ্রহণযোগ্য ইত্যাদি) ছাড়া আর কোন এথিক্স আসার কোন সম্ভাবনা নেই।

যেকোন জীবনব্যবস্থা আলাদা করে কোন নৈতিকতার জন্ম দেয় না। বরং বৈশিষ্ট্যগতভাবেই তা সমাজে বিদ্যমান থাকে। যেমন ইসলামি জীবনব্যবস্থায় আলাদা করে কোন নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া হয়নি। বরং পুরো জীবনব্যবস্থাই স্রষ্টার আদেশ ও নিষেধের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। “মিথ্যা বলা যাবে না” এটা খারাপ কাজ এই জন্য নিষেধ না। বরং এটা আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা নিষেধ করেছেন তাই করা যাবে না। একইভাবে মানুষ তার মৌলিক চাহিদা ও প্রবৃত্তি পূরণের জন্য মানুষের মন থেকে নির্ধারিত “ভালো-মন্দ”কে অনুসরণ করবে না, বরং আল্লাহ্‌’র বিধি-নিষেধকে মেনে চলবে। কারণ স্রষ্টাই সবচেয়ে ভালো জানেন কোনটা মানুষের জন্য ভালো, কোনটা মন্দ। স্রষ্টার আদেশ নিষেধ যখন সমাজে সামগ্রিকভাবে প্রয়োগ হয়, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়। আলাদা করে নৈতিকতাকে জোর করে চাপানো লাগে না। “যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই কি জানেন না? তিনি সূক্ষ্মজ্ঞানী ও সম্যক অবগত” [সূরা মুলকঃ ১৪]।

    - জাবির জোহান

Previous Post Next Post